নবম অধ্যায়
৪। সম্পত্তি দখলের নীতিগুলি
আওরঙ্গজেবের সময় এবং মুঘল আমলে মৃত আমলাদের সম্পত্তি দখলের বিষয়টি এবং তার নীতিগুলি নিয়ে নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে একটা বিষয় মনে হয়েছে যে, এই নীতিটির মূল সূত্র দুটি নীতির মিলমিশ - কোরানিয় আইনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি পুরোনো এবং বিদেশি পরিযায়ী আদিবাসী সমাজের যৌথ সম্পত্তির ধারণার নীতি।
তুর্কি, দিল্লিতে যারা পাঠান মুঘল নামে চিহ্নিত, জাতিগতভাবে তারা ছিল পরিযায়ী আদিবাসী সমাজ এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাদের পরিযায়িতার চরিত্র, সাম্রাজ্যের বিপুলতা এবং বিপুল ব্যয় এবং বিভিন্ন ইন্সটিটিউশন তৈরি আর চালানোর মধ্যেও কিন্তু হাল্কা ঘোমটা দিয়ে বজায় রেখে গিয়েছে। এঁরা এক পশুচারণভূমি থেকে অন্য পশুচারণভূমিতে পরিযায়ী হয়ে নতুন জমি, নতুন দাস এবং সম্পদ সংগ্রহ করত, পরিবার আর সেনাবাহিনী একই ছাতার তলায় ছিল। গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন কুলপতি, প্রত্যেক সদস্য(আরও সঠিকভাবে বললে, প্রত্যেক পরিবারের মাথা) ছিলেন গোষ্ঠীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তারা আদিবাসী সমাজ থেকে তাদের পরাক্রম আদায় করে তাদের পারশ্রমিক তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদরূপে যোগ করতেন। বাইরের গোঠীর সঙ্গে বিবাহে বা নতুন দাস যোগ করে গোষ্ঠী নতুন সদস্য যোগ করত, তবে নতুন যোগ দেওয়া সদস্যরা কিন্তু ক্রমেই হয়ে উঠত গোষ্ঠীর অংশ যেন তারা গোষ্ঠীতেই জন্মগ্রহণ করেছে।
ভারতে যেসব আদিবাসী গোষ্ঠী শাসন করতে এসেছে তারা তাদের কুলপতিদের থেকে সৈন্য আর অর্থ পেয়ে ভারতের নানান এলাকা আক্রমন এবং লুঠ করেছে এবং তা ভোগও করেছে। কিন্তু যখন তারা মারা যায়, আদিবাসী গোষ্ঠীর নীতি অনুযায়ী তাদের সম্পত্তিগুলি রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়ে যায়, কেননা তারা, এই উদ্যমীরা আদিবাসী গোষ্ঠীদ্বারা(এখানে সম্রাট) নিযুক্ত এবং তাদের থেকে অর্থ সাহায্য পেয়েছে এই কাজ করতে। তুরানি বাসভূমির এই নীতি মোঘলেরা ভারত সাম্রাজ্যেও কাজে লাগিয়েছিল। মুঘল সাম্রাজ্যে এমন কোন অভিজাত ছিল না যারা রাষ্ট্রের দ্বারা নিযুক্ত নয়, অন্তত মনসব স্তরে কাজ করেছেন। তার কাজের জন্য তিনি আগ্রিম অর্থ(মুসাইদত) এবং নানা হাতিয়ার(আজনা) অথবা খাঞ্জাঞ্চি থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে, এগুলিকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে আরো বেশি অর্থ যোগাতে বাধ্য থাকতেন, এবং শেষমেশ তাকে তার লুঠ থেকে একটি ক্ষুদ্র লভ্যাংশ পারিতোষিক হিসেবে দেওয়া হত। ফলে রাষ্ট্র যে সব সম্পত্তি আইনগতভাবে দখল নিত, যেমন করে খ্রিষ্টান পাদ্রিদের রোজগার যেত তার গোষ্ঠীত খাজাঞ্চিতে। আর যদি শিল্পউদ্যমের কথা ভাবি তাহলে এই অভিজাতরা হলেন আদিবাসী জয়েন্টস্টক কোম্পানির একএকজন সদস্য যাদের কোম্পানির স্বার্থ পূরণে বিভিন্ন সম্পদে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুর্ক সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনে রাষ্ট্রের কর্মচারীর নিজস্ব সম্পত্তি আসলে ক্যাথলিক পাদ্রিদের বা ফ্যাক্টরি ম্যানেজারদের অবস্থার অনুরূপ।
দক্ষিণী রাষ্ট্রে বা দিল্লিসহ সারা ভারতে সমগ্র মুসলমান যুগের বিস্তৃতি, সম্রাট নামক কেন্দ্রিয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে বা নির্দেশে অধস্তন মাইনে করা কর্মচারী দিয়ে ভারত দখলের কাজ হিসেবে না দেখে, তার থেকে বরং বলা ভাল রাষ্ট্রের এবং তার বিভিন্ন শক্তির সাহায্যে এবং বিনিয়োগে ব্যক্তি উদ্যমীদের দখলদারি হয়েছে।
ফলে রাষ্ট্রের দাবি, তাদের কর্মচারীরা যা অর্জন করেছে, তা রাষ্ট্রের দেওয়া আর্থিক এবং সামরিক সাহায্য। ভারতীয় সাম্রাজ্যর সম্পত্তির ধারণ অনেকটা আসলে ইসলামের ঐ আদিবাসী গোষ্ঠীর সম্পত্তির ধারণার কাছাকাছি, এবং আমির, সুলতান বা পাদশাহ যারা আদতে ইসলামে বিশ্বাসীর সেনাপতি, তাদের দায় হল, আধিকারিকদের সমস্ত সম্পত্তি ইসলামের নামে বাজেয়াপ্ত করা। গোষ্ঠীর প্রধানের মত সাম্রাজ্যের প্রধান পাদশাহ হলেন আদর্শ বিশ্বাসীর সার্বভৌম ধর্মসভার (জামায়েত)একমাত্র অছি, যেমনভাবে ইসলামে দীক্ষা নেওয়ার আগে কুলপতি হিসেবে তার কাজ ছিল। পরিযায়ী গোষ্ঠী পিতৃতান্ত্রিক(ইসলামের পূর্বে) তা ধার্মিক(ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরে), যাই হোক না কেন, সম্পত্তির অধিকার সামগ্রিক গোষ্ঠীর।
তুর্ক রাষ্ট্রের এই মৌলিক নীতি আধুনিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতার এবং কেউ যাতে কারোর সম্পত্তি দখল করতে না পারে, তারা সম্পত্তি রক্ষার কাজে ভগবানের প্রতিনিধি, এই ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না – কিন্তু এটাই ইসলামের ব্যক্তিগত আইনেরও এক অংশ। এবং আওরঙ্গজেবের নীতিসমূহ এই দুটি ধারণার আপোষও বলা যেতে পারে। একদিকে এটি পরিযায়ী আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব গোষ্ঠী সম্পত্তির ধারণা অন্যদিকে আধুনিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণার মিলমিশ। আমার ভাষ্যে, সম্রাটের মৃত কর্মচারীর সম্পত্তি দখলদারির কাজকে যদি শুধুই একজন একনায়কের সম্পদ লালসা বলে অভিহিত করি তাহলে তা সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক হয়ে যাবে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment