সপ্তম অধ্যায়
সম্রাটের বিশেষ ক্ষমতা
পার্সি সূত্র থেকে আমরা মুঘল সম্রাটের কোন কোন বিষয়ের অধিকারগুলি সংরক্ষিত ছিল
তা জানতে পারি। সেই সূত্রে যে বেআইনি আর নানান অপকর্মগুলিও করতে হয়েছিল তাও জানতে
পারি।
প্রত্যেক সুবাদারের স্বপ্ন ছিল সুবাভুক্ত অঞ্চলে নিজের ক্ষমতার আওতায় সম্রাটের
মত আচরণ করা। এই কাজে সব থেকে দুর্বিনীত ছিল দেশের চারটে প্রান্ত এলাকার সর্বোচ্চ
ক্ষমতার চারজন সুবাদার, যাদের সঙ্গে তুলনা করা যায় সামন্ত ইংলন্ডের ‘মার্চার
আর্ল’দের ক্ষমতার। এবাবদে সব থেকে (দুঃ)নাম করেছিলেন, ১৬০৮ থেকে ১৬১৩ পর্যন্ত
বাংলায় সুবাদারি করা অসম্ভব উদ্ধত আর স্বেচ্ছাচারী ইসলাম খাঁ চিস্তি। জাহাঙ্গির
তার রাজত্বের ষষ্ঠ বছরেই, ১৬১১য়, একটি রাজকীয় ফরমান জারি করে সুবাদারেরা কি কি
করতে পারবে না, তাদের কোন কাজগুলি সম্রাটের বিশেষ ক্ষমতাকে লঙ্ঘন করছে, তা বয়ান
করেন(সূত্রঃ তুজুকইজাহাঙ্গিরি, বাহারিস্তান, ইবালনামা, মিরাটিআহমদি)।
আওরঙ্গজেবও সম্রাটের আভিজাত্য আর অধিকার বিষয়ে খুব সচেতন ছিলেন, এমন কি তার
পুত্ররাও সেই অধিকারের ক্ষমতা লঙ্ঘন করার চেষ্টা করলে, তিনি তা কেঠোরভাবে শাস্তি
দিয়ে সেই অধিকারগুলো রক্ষা করেছেন।
তিনি বলতেন, ‘যদি একটা রীতি উল্লঙ্ঘন করা হয়, তা হলে সব আইন ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমি নিজে অনেক আইন লঙ্ঘন করতে ভয় পাই, অথচ মানুষ এতই ধৃষ্ট হয়ে উঠেছে যে আমায় আইন
লঙ্ঘন করতে অনুরোধ করছে(আহকমইআলমগিরি)!
আবার সেই সূত্রে জানতে পারছি তার স্বগতোক্তি, ‘কিভাবে সে(পুত্র শাহজাদা
মুয়াজ্জম বা শাহ আলমের উদ্দেশ্যে) সম্রাটের জন্য সংরক্ষিত অধিকারগুলি উল্লঙ্ঘন
করে! প্রয়াত সম্রাট শাহ জাহান তার পুত্রদের বিষয়ে চরম উদাসীন ছিলেন, সেই জন্য তার সময়টি
কুখ্যাত হয়ে ওঠে’(ঐ)।
সরকারি মহাফেজখানা থেকে পাওয়া নথিপত্রের সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই দুই রাজত্বে
অন্তত ১৬টি অধিকার শুধু সম্রাটের জন্য সংরক্ষিত ছিল, অন্যান্যরা যে যতই ক্ষমতাধর
হোক না কেন, সেগুলি পালন করতে পারত না।
প্রথমটি, অলিন্দ থেকে সকালে জনগণের উদ্দেশ্যে দর্শন দেওয়া। আকবর এটি শুরু করেন।
ঐতিহাসিক আবুল ফজল লিখছেন – ‘মহামহিম চব্বিশ ঘন্টায় দুবার এই কাজটি করতেন, যাতে
সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ সম্রাটকে চোখ আর হৃদয় পূর্ণ করে দর্শন করতে পারে। সকালে
আজান শেষ করেই তার অলিন্দের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে দর্শন দিতেন, যাতে তার
দণ্ডধারীদের থেকে উতপাতবিহীনভাবে জনগণ তাঁকে দেখতে পারেন’।
আগ্রা-প্রাসাদের(এবং দিল্লিতেও) পূর্ব দেওয়াল থেকে একটা অলিন্দ ছিল, নাম ছিল
ঝরোখাইদর্শন। সম্রাটের দুর্গের নিচে বালুময় তটে বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হতেন।
সূর্য ওঠার পৌনে তিন ঘণ্টা পরে তিনি তার প্রাসাদের অলিন্দে এসে দাঁড়াতেন,
দর্শনার্থীদের অভিবাদনের উত্তরে তিনি তাদের সেলাম জানাতেন। আধঘন্টা বা কিছু বেশি
সময় সেখানে কাটাতেন শুধু দর্শন দিতে নয়, বরং বেশ কিছু জরুরি কাজও করতেন। দুর্গের
তলায় যেহেতু সমতল ভূমি, তাকে জনগণের দেখতে পাওয়া খুব একটা সমস্যা ছিল না, কিছু
কিছু নিপীড়িত তাদের দাবিদাওয়া, অভিযোগ তার সামনে পেশ করতেন, দারোয়ান, রাজসভার কর্মচারীদের
ঘুষ বা তোল্লাই না দিয়েই। কখোনো কখোনো একটি তার অলিন্দ থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হত,
সেখানে দর্শকেরা তাদের অভাব-অভিযোগ লিখে বেঁধে দিত, এবং সম্রাটের কর্মচারীরা তা
নিয়ে সম্রাটের হাতে দিত০।
মহারাজকে দর্শনের জন্য এক ধরণের শ্রেণী তৈরি হয়েছিল, যাদের নাম দর্শনিয়া, যারা
নিজেদের সম্রাটের ভক্ত হিসেবে দাবি করত, রোমান সাম্রাজ্যের অগাস্টেলদের মত অনেকটা।
তারা উপবাসে থেকে, কোন প্রাতঃকৃত্য না করেই সম্রাটের শ্রীমুখ দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত
হয়ে বসে থাকত দুর্গের প্রাকারের তলায়, যেমন করে জগন্নাথ দেব বা গয়ায় হিন্দু
পূণ্যার্থীরা দেব-দেবী দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। ঔরঙ্গজেব এই মানুষ পুজো করার
প্রথা বন্ধ করে দেন তার রাজত্বের ১১তম বছর থেকেই(কাফি খাঁ)।
দ্বিতীয়ত, চৌকি আর চৌকির তসলিম, বিশেষ শ্রেণীর এক পাহারাদার সম্রাটের
প্রাসাদের চারদিকে ঘুরে ঘুরে সেলাম জানাত। আকবর এই প্রথাটি শুরু করেন। আইনিআকবরি
থেকে বিষয়টি তুলে দেওয়া গেলঃ মাউন্টিং গার্ডেদের হিন্দিতে নাম ছিল চৌকি। সেনার
চারটে টুকরিকে সাতভাগে ভাগ করে, একএকটিকে একজন বিশ্বাসী অভিজাত মনসবদারের অধীনে এক
দিন পাহারার দায়িত্ব দেওয়া হত। তারা রাত দিন প্রাসাদে অপেক্ষা করে থাকত, সম্রাটের
যে কোন নির্দেশ পালন করার জন্য। সন্ধ্যের সময় সাম্রাজ্যের মাণদণ্ড(কুয়র) দেওয়ানি
আমে নিয়ে যাওয়া হত। বাঁদিকে এই মাউন্টিং গার্ডেরা দাঁড়িয়ে থাকত, ডান দিকে দাঁড়িয়ে
থাকত যে সব সৈন্যদের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে, এই দুই সারির অভিবাদনের মধ্যে দিয়ে সেই
রাজদণ্ডটির সঙ্গে যাওয়া সম্রাটকে কুর্ণিশ করত। সেই সৈন্যদের মধ্যে উপযুক্ত কারণ
ছাড়া যদি কেউ অনুপস্থিত থাকত, তার জরিমানা হত সেই সপ্তাহের মাইনে এবং অন্যান্য
শাস্তিও বরাদ্দ ছিল’।
বার্নিয়ে আরও বিশদে লিখেছেনঃ
‘উমারা রোটেশানে সম্রাটের প্রাসাদ ঘিরে থাকত, প্রত্যেক সপ্তাহে, দিনের চব্বিশ
ঘন্টা ধরে। সে সেখানে তার বিছানা, গালিচা এবং অন্যান্য জিনিস বাড়ি থেকেই নিয়ে যেত,
সম্রাট তাকে দিতেন শুধু খাওয়ার। এই খাদ্যটিও একটি বিচিত্র রীতিতে তার সামনে
উপস্থিত করা হত। উমারা তিনবার তসলিম করে সম্রাটের ঘরের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
করত, প্রথমে হাতটি মাটিতে নামিয়ে আনত, তারপর সেটি তুলত মাথা পর্যন্ত’।
রাজারা(হিন্দু মনসবদারেরা) এই প্রাসাদের ভিতরের রক্ষীদলে থাকতেন না, তারা
থাকতেন দেওয়ালের বাইরে, তাদের নিজেদের তাঁবুতে।
এই সেনাদের চব্বিশঘন্টা পাহারা দিতে হত, যা অভিজাতদের পক্ষে ভোগান্তি ছাড়া আর
কিছু না কিন্তু সম্রাট এটি তাদের করতে বাধ্য করতেন। সুবাদারদের কয়েকজন তার
সেনাবাহিনীকে দিয়ে চালাকি করে এই কাজটি করাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত
করাতে পারেন নি।
No comments:
Post a Comment