পঞ্চম অধ্যায়
করব্যবস্থা
৪। নিচের দিককার
রাজস্ব কর্মচারীরা পীড়ক এবং জুলুমবাজ
মুঘল আমলে নিচের
দিককার কর্মচারীরা চরমতম দুর্ণীতিগ্রস্ত আর অন্য দিকে ওপরের তলার আমলারা ঠিক ততটাই
দেশনায়কচিত। কিছু ব্যতিক্রম ছিলেন যারা রাজস্ব আদায়কে কাগজে কলমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে
দেখিয়েছিলেন এবং তার আদায়ের পদ্ধতিটি নিলামে তুলে রাষ্ট্রকে ডকে তোলার বন্দোবস্ত
করেছিলেন। এর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ পাই সপ্তদশ শতের ওডিসায়।
১৬৬২ সালে ওডিসার
সুবাদার লিখলেনঃ ‘নতুন দেওয়ান মহম্মদ হাসিমের অত্যাচারে এবং অবাস্তব রাজস্বের
দাবিতে সুবার মহালগুলি জনশূন্যরূপ ধারণ করেছে। তার কর্মপদ্ধতি ছিল নিম্নরূপঃ যে
ব্যক্তি ক্রোরিরপদ অলঙ্কার করবে, সে তার এলাকায় গিয়ে মোট উৎপাদন বিচার করার আগেই
হাসিম তাকে তার ইচ্ছেমত একটা অঙ্ক বসিয়ে রাজস্ব আদায়ের বেসরকারি ফর্মান জারি করে।
কিছু দিন পরে অন্য একজন সেই পদে বসলে হাসিম খান তার থেকে ঘুষ নিয়ে পুরোনো ক্রোরিকে
পদচ্যুত করে, নতুন পদাধিকারীকে তার থেকেও বেশি আদায়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে নেয়। কিছু
দিন পরে তৃতীয় একজন উদয় হয়ে দ্বিতীয় জনের থেকে বেশি রাজস্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেও
পদ বাগিয়ে নেয় এবং হাসিম তার বড় কর্তাদের দেখায় যে রাজস্ব (কাগজে কলমে) দ্বিগুণ-তিনগুণ
বেড়েছে, আর রায়তেরা সেই পরিমান রাজস্বের দাবি না মানতে পেরে পালিয়ে বাঁচছে এবন
গ্রামগুলি বুনো জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে’।
কিছুদিন পরে এই
ব্যক্তি তার পদ থেকে কর্মচ্যুত হয়।
সম্রাট, দেওয়ান
এমনকি সুবাদার হয়ত কৃষকদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। কিন্তু নিচের দিকে যে
মানুষটা রাজস্ব আদায় করছে সরাসরি রায়তের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, তার অত্যাচার বা খাঁই
রায়তকে অনেক বেশি আঘাত করে। তখন তার আর মাথায় থাকে না যে সম্রাট তার সত্যিই ভাল
চান। সম্রাট তার কাছে দূর গ্রহের তারা, ফলে সে তার অভিযোগ নিয়ে তাঁর দোরগোড়ায়
পৌঁছতে পারে না।
মুঘল আমলের অন্যতম
প্রখ্যাত প্রধান দেওয়ান সাদুল্লা খাঁ বলতেন যে দেওয়ান তার প্রজাদের ওপর হওয়া
অত্যাচার রুখতে পারে না, সে হাতে দোয়াত কলম নিয়ে বসে থাকা একজন শয়তান ছাড়া আর কিছু
নয়। এই তীক্ষ্ণ রসব্যাঙ্গের শোভনতা পরিষ্কার হয়ে যায় যখন তিনি বলেন পারসি অক্ষর
এ-তে রয়েছে একটা দীর্ঘ লম্বা লাইনের সঙ্গে দেখতে একটা বিপরীতাত্মক লাইন যা
খাগড়াকলমের মত দেখতে; আর এন অক্ষরটি একটি দেশি দোয়াতের মত দেখতে। আর দিউ শব্দের
অর্থ, শয়তানি আত্মা। ফলে এই তিনে মিলে দেওয়ান শব্দের অর্থ হয়ে গেল একজন শয়তানি
আত্মা সামনে দোয়াত আর কলম নিয়ে বসে রয়েছে (রুকাতিআলমগিরি, চিঠি নং ১৫৪)।
নিচের তলার
আধিকারিকদের অত্যাচারের প্রবণতা ময়ূর সিংহাসনের মালিকের শাস্তির দেওয়ার বাইরে ছিল,
এবং আমরা দেখব, শাহজাহান মারা যাওয়ার পর ৫০টি আবওয়াব আদায় হত।
৫। রাজস্ব
কর্মচারীরা (চাষীদের)দোহন করত কেন
পূর্ব বা পশ্চিম,
উভয় গোলার্ধের দেশগুলিতে সুবাদার থেকে নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীরা চাষীদের দোহন করার
কাজ করত, এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে এটি সব থেকে বড় অশুভমকর্ম ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যে এই
দুর্নীতিটি তিনটে কারণে আরো জাঁকিয়ে বসে, ১) সম্রাট, যুবরাজ বা অন্যান্য উপরতলার
কর্মচারীকে অপব্যয়ী উপঢৌকনের যে রীতি ছিল, তার পুরোটাই আদায় করা হত নিচের তলার
কর্মচারীর মাধ্যমে, ২) নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন খুব কম ছিল, ৩) আর মানুষের
নতমস্তকী আর উদাসীন মনোভাবও এটাকে বাড়িয়ে তোলে।
উপরতলার প্রথা এবং
সামাজিক সামাজিক শিষ্টাচার আর উপরতলার কর্মচারীদের তোয়াজে রাখার জন্য উপঢৌকন প্রথা
চালু হয়েছিল। সুবাদারেরা সম্রাটের জন্মদিনে বা সুবার রাজসভায় তার আগমনের উদ্দেশ্য
করে তাঁকে বহুমূল্য উপঢৌকন দিতেন। প্রধান দেওয়ানকে দেওয়ার জন্যও একই পদ্ধতি অনুসরণ
করতে হত।
উপঢৌকনের এই চাপ
উপরের বা মাঝারিস্তরের কর্মীরা নিচের দিকে চালান করে দিতেন। ফলে এই ব্যবস্থা নিচের
তলায় যে চাপ তৈরি করত তা ওপরের দিকে থাকা রাজকর্মচারীরা বা সম্রাটেরা বুঝতেন না। সম্রাটকে
খুশি করতে সুবাদার চাপ নিতেন, আর সুবাদার সেই চাপ ছড়িয়ে দিতেন জমিদারদের ওপর; আর
সুবার দেওয়ান প্রধান দেওয়ানকে খুশি করতে চাইতেন উপঢৌকন দিয়ে, তিনি তার অধস্তন
কর্মচারীদের নিংড়ে নিতে চাইতেন; ফলে এই নিচের স্তরের রাজস্ব কর্মচারীরা তাদের ন্যাহ্য
দাবি নিয়ে উপস্থিত হতে রায়তের দরবারে, তার গলা চিপে ধরতে।
এই পদ্ধতিটি ঘুষ
দেওয়ার প্রবণতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, মানে যেখানে বিচার প্রহসনে পরিণত হয়েছে, প্রশাসনের
ন্যুনতম সেবা দেওয়ার প্রবণতা ঢিলে হয়ে গিয়েছে, সেখানে বিচারের বাণীকে নিজের দিকে
টেনে আনতে ঘুষের প্রয়োজন হয়, তা মানুষের স্বাভাবিক কর্তব্য নয় এবং রাষ্ট্রের স্থিতির
পক্ষেও বিপজ্জনক। মুঘল আমলে ঘুষ নেওয়া একটা দুর্ণীতিপূর্ণ, মানবতাহীন প্রথা বলে
মনে করা হলেও, সর্বস্তরে ঘোমটার আড়ালে ঘুষ গ্রহন কিন্তু স্বাভাবিক কাণ্ড হয়ে
দাঁড়িয়েছিল।
করণিকদের কম মাইনে
দেওয়ার ফলে তারা তাদের কাছে সেবা চাইতে আসা মানুষদের নির্দিষ্ট কাজের বিনিময়ে
বেআইনি দস্তুরি চাইত। এটাকে বলা হতম ‘করণিকের প্রাপ্য’ হুকউলতাহারির(বা নিচের
দিকের আদালতে তাহারিরি, আজও বহু দপ্তরে এই শব্দটি চালু রয়েছে।) কর্মীদের কার্য
নির্দেশের ৭৪ পাতায় হিসাব পরীক্ষক(মুশরিফ)কে বলাহচ্ছে, ‘মানুষ যদি স্বেচ্ছায় কেরাণির
প্রাপ্য’ দিতে চায়, তাঁকে তা নিয়ে দাও; যার চাহিদা মাসে ৫০ টাকা, তাঁকে যদি ২০টাকা
মাসে দেওয়া হয়, তার কি করে চলে?’
(চলবে)
No comments:
Post a Comment