নবম অধ্যায়
৫। দখলি রাজনীতির প্রভাব
তাত্ত্বিকভাবে সম্পত্তি দখলের যাই নীতি হোক না কেন, তার বাস্তব অবস্থা কিন্তু খুবই ক্ষতিকারক হয়েছিল। আধুনিক এক লেখক, এই প্রথাকে সমর্থন জানিয়ে লিখেছেন, এই প্রথাটির প্রয়োজন ছিল, কেননা, এর দ্বারা কিছু পরজীবি শ্রেণীর মানুষের বংশপরম্পরার জমানো সম্পদের ওপর নির্ভর না করে বেঁচে থাকার জন্য লড়াইএর মানসিকতা জন্ম দিত এবং যোগ্যতমের উদ্বর্তন ঘটত, ফলে সরকারের কাজের দক্ষতা বাড়ত। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এই যুক্তিটি ঠিক নয়। সম্পত্তি দখলের অন্যতম প্রভাব হল অভিজাতদের অসংযত জীবনযাপনে, মহিলাদের সঙ্গে খোলাখুলি বেলেল্লাপনা করার কাজে, তাদের কাজের সময়ে অতিরিক্ত খরুচে হয়ে ওঠার জন্য পরোক্ষে উৎসাহ দেওয়া হয়, কেননা, সেই সব কর্মচারীরারা জানে যে সম্পদ তারা তাদের জীবনে ভোগ করছেন, তার কোন অংশই তারা তার মৃত্যুর পর পরিবারের উত্তরাধিকারীর জন্য রেখে যেতে পারবেন না, এই বিপুল সম্পদ ভোগ করবেন একমাত্র সম্রাটই। এই বিপুল পরিমান অপচয়ে সমাজের সর্বোচ্চস্তরে চরম নৈতিকতার অধপতন ঘটেছিল।
আর নিজেদের পরিবারের সম্পত্তির ওপর চরম নিরাপত্তার অভাব এ দেশে বেসরকারি সঞ্চয়ে, ফলে সরাসরি বিনিয়োগে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। ফলে সাধারণত সভ্যতার মান এবং সংস্কৃতি নিচু স্তরেই থেকে যায়, কেননা, প্রত্যেক প্রজন্মকেই তার পূর্বজ যা করে গিয়েছিলেন, তার উত্তিরাধিকার সরিয়ে রেখে, নতুন করে সম্পদ সংগ্রহের কাজ তৃণমূলস্তর থেকেই শুরু করতে হত।
কোন কোন সময়ে এই হড়পে নেওয়ার কাজে গোপনে আড় হয়ে দাঁড়াতেন অভিজাতরা। আমরা বেশ কিছু তথ্য আহরণ করতে পেরেছি, যেখানে অভিজাতরা তাদের মৃত্যুর আগে গোপনে তাদের সন্তানের জন্য বেশ কিছু সম্পত্তি লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন।
অন্য বহু ক্ষেত্রে তাদের ভৃত্য আর প্রতিবেশীরা সম্রাটের প্রহরীরা সম্পত্তি দখল নেওয়ার আগেই তাদের সম্পদ লুঠ করে নিত। আমরা পড়েছি যখন রাষ্ট্রের পেয়াদা আমির খাঁএর সম্পত্তি দখল করতে এল, তার বিধবা কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে রুখজে দাঁড়িয়েছিলেন।
দম্পত্তির দখলদারির রাজনৈতিক প্রভাব খুব সুদূরপ্রদারী হয়েছিল। বহুকাল ধরে ভারত ছিল এমন এক দেশ, যেখানে বংশপরম্পরার সম্পদ এবং তাদের উত্তরাধিকার রাজার দয়ার ওপর নির্ভর করত না, ফলে তারা রাজার স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বৈরশাসনের সরাসরি বিরোধিতা করতে পারত। কিন্তু এই প্রথা মুঘল অভিজাতদের স্বার্থপর পরে তুলেছিল, তারা যে কোন ছলে দেশিয় যুদ্ধ, সিংহাসনের লড়াই বা বহিঃশত্রুর আক্রমনে চেষ্টা করত বিজয়ীদের পক্ষে চলে যাওয়ার, কেননা তারা জানত, যে তারা যে সম্পত্তি এবং জমি ভোগ করছে, তা তাদের আইনি অধিকারে নেই, এবং সেগুলি থাকা না থাকা নির্ভর করছে শুধুই সম্রাটের ইচ্ছের ওপর। ব্যারণেরা যেভাবে রাজা জনের থেকে ম্যাগনা কার্টা আদায় করে নিয়েছিল, প্রথম চার্লসকে যেভাবে সংযত করতে পেরেছিল, সেই আন্দোলন মুঘল আমলা সম্ভব ছিল না। মধ্যয্যগের মুঘল আমলে সম্রাট আর সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরপেক্ষ অভিজাত বা ব্যবসায়িক সম্প্রদায় ছিল না যারা এই দুই শক্তির মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারে। এই ধরণের সরকার অর্থনৈতি এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে খুবই পলকা এবং অস্থিতিশীল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment