ষষ্ঠ অধ্যায়
আইন ও বিচার ব্যবস্থা
৩। কাজি আর তাঁর কাজ
প্রত্যেক সুবার রাজধানীতে কাজিকে নিয়োগ করতেন সাম্রাজ্যের প্রধান কাজী- কাজিউলকুজাত; কিন্তু সুবায় কাজীর নিচে কোন নিম্ন আদালতের অস্তিত্ব ছিল না। ফলে কোন মহকুমা আদালতও ছিল না। প্রত্যেক শহরে কাজি নিযুক্ত হতেন, আর মুসলমান প্রধান বড় গ্রাম, যেগুলিকে কসবা বলা হত, সে সব ভৌগোলিক এলাকাতেও কাজি নিয়োগ হত। অন্য কোন অমুসলমানপ্রধান গ্রামে কাজি ছিল না, কেউ যদি যথেষ্ট সম্পদশালী হত তাহলে সে পাশের শহরে গিয়ে কাজির কাছে বিচার চাইতে পারত।
সুবায় নিযুক্ত কাজির বিচারের এলাকা ছিল বেশ বড়, তাঁর কোন সহকারী ছিল না, যে তাঁর কাজ হাল্কা করার কাজে অংশ নিতে পারে। ফলে সুবার খুব ক্ষুদ্র অংশের বিচার করতে পারতেন কাজি। আমরা আজ যে দারুণ খুশি অনুভব করি, সুযোগ পেলেই, নিজের দোরগোড়ায় থাকা সরকারি আদালতে কিছু না কিছু দেওয়ানি মামলা ঠুকে দিতে পারি এবং তারপর একের পর এক উচ্চ আদালতে গিয়ে সদর্থক বিচার চাওয়ার অধিকার উপভোগ করতে পারি, মুঘল সাম্রাজ্যে ভারতীয় একজন গ্রামীন সেই অবাধ খুশির আরামটা পেত না।
ফলে প্রতিবাদীরা হয় তার গ্রাম্য প্রধানের নেতৃত্বে চলা জাতি আদালত গিয়ে বিচার চাইত (উত্তরভারতে পঞ্চায়েত আর দক্ষণ ভারতে মাহাজার), বা কোন পক্ষপাতহীন মধ্যস্থকে রেখে বিচার করত অথবা নিজের বাহু বা ক্ষমতা বলের ওপর নির্ভর করে ঘটনার বিচার করত।
৪। কাজির অবস্থান আর তাঁর ক্ষমতা
তাত্ত্বিকভাবে কাজির কাজ হল বিচারক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করা; তিনি অন্যদের থেকে আইন জেনে বিশেষ কোন মামলার প্রমানগুলি যাচাই করে তাঁর রায় শোনান। আইন বর্ণনা আর ব্যাখ্যার কাজ করেন মুফতি, আজকের ভাষায় যাকে বলতে পারি এডভোকেট জেনারেল। ‘মুফতি হলেন আইনের ব্যখ্যাকার এবং বিভিন্ন মামলায় আইন প্রয়োগকারী কাজি, তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করেন’(এনসাইক্লোপিডিয়া অন ইসলামএ বলা হচ্ছে, ‘কাজি দাগহীন নির্মল চরিত্রের মুসলমান পণ্ডিত, যিনি পবিত্র আইন প্রয়োগ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত...অতীতের নানান মামলার লিখে যাওয়া ‘ফিক’ বইএর উদাহরণের পদচিহ্ন ধরে তিনি এগোবেন... কাজির রায় শেষ কথা, তাঁর ওপরে কোন আবেদন নিবেদন চলে না’)।
‘সাফী ছাড়া যে কোন মুসলমান আইনের প্রথা বলছে, অশিক্ষিতরাও কাজিরূপে কাজ করতে পারেন, কেননা কাজি অন্যদের আইন ব্যাখ্যার ওপরে নির্ভর করে তাঁর রায় প্রদান করেন। তাঁর নিয়োগের উদ্দেশ্য শুধুই অন্যান্যদের মতামতের ওপরে নির্ভর করে রায় শোনানো তার বেশি কিছু নয়’(হ্যামিলটনের অনুবাদে হেদায়া)।
সাধারণত বহু কাজি ছিলেন বিখ্যাত শিক্ষিত উকিল, তবুও কাজির পদে বসার প্রাথমিক যোগ্যতা ছিল, সততা, পক্ষপাতহীনতা, পুণ্যবান হওয়া, তাঁর সময়ের সমাজের নানা কিছু(ক্লেদ) থেকে বহুদূরে অবস্থান করা(হেদায়ার অনুবাদ এবং ম্যানুয়্যাল)।
কাজি চরিত্র সম্বন্ধে যা উচ্চমান আদর্শায়িত করা হয়েছে নানান তাত্ত্বিক পুস্তকে তা সাধারণত বাস্তবের সঙ্গে মিলত না, যদিও মুসলমান দেশগুলিতে আদর্শ কাজি বাস্তবে যে ছিল না, তা বলা যাবে না। আওরঙ্গজেবের সময়ের প্রথম এবং প্রধান কাজী আবদুল ওয়াহাব বোরা সম্বন্ধে বলা যায় যে তাঁর মত দুর্ণীতিবাজ মানুষ সে সময় কম পাওয়া যায়, ১৬টি বছরে কাজির কাজ করে বিপুল পরিমান গয়না, অন্যান্য দামি বস্তুর সঙ্গে সঙ্গে ৩৩ লাখ টাকা উপার্জন করেন। কিন্তু তাঁর পুত্র এবং উত্তরাধিকারী শেইখুলইসলাম পিতার উল্টো চরিত্রের মানুষ ছিলেন। বাবার ঘুষের একটা টাকাও তিনি ছোঁননি, বরং সেগুলি তিনি জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি শুধু নিরপেক্ষ এবং দুর্ণীতিমুক্তভাবে মামলার বিচার করতেন তাই নয়, তাঁর ঘনিষ্ঠ এবং আত্মীয়দের থেকেও কোন উপহার নিতেন না(হিস্টোরি অব আওরঙ্গজেব)।
কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যে কাজিরা সাধারণত প্রশাসনের খুব সাহায্য পেতেন না। বার্ণিয়ে বলছেন, ‘কাজিদের হাতে এমন কোন ক্ষমতা নেই যার দ্বারা তিনি সমাজের অখুশি মানুষের(কৃষক, কারু শিল্পী এবং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জায়গিরদার, প্রশাসক এবং রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচার) বিরুদ্ধে যে সব ঘটছে তাঁর প্রতিবিধান করতে পারেন। রাজধানী বা তাঁর আশেপাশের শহরগুলিতে দৃশ্যত এই দুঃখজনক ক্ষমতার অপব্যবহারের নানান নিদর্শন সাধারণত অনুভব করা যায় না, কেননা যে কোন বিশাল ধরণের অবিচার আদালতের দৃষ্টির বাইরে থাকে না’। আবারও বলছেন, ‘যে ভালতম আদর্শ-আইন প্রয়োগ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই, সেই আইনের উপযোগিতা কি? সত্যি করে বলতে গেলে প্রশাসক ভগবানের বাড়া। তিনি নিজে শাস্তি দেন, বিচার করেন, নিজেই নিজের সংসদ, রাষ্ট্রপতি-সভা, আর রাজার রাজস্ব আদায়ের এবং নির্ধারণের একমাত্র ব্যক্তি... পূর্বের দেশগুলিতে যারা দুর্বল, যারা আহত, তাদের কোন আশ্রয়স্থল নেই; একমাত্র চাবুক আর প্রশাসকের খেয়ালখুশিই সমস্ত বাদপ্রতিবাদ নিষ্পত্তি করে’।
বার্নিয়ে এখানে রাজস্ব আদায় এবং প্রশাসনিক অত্যাচারের প্রসঙ্গে এত কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু শরিয়তি আইনে মামলাগুলি বিচারের কথা বলছেন না, শরিয়তি আইনে কাজির বিধানই শেষ কথা, প্রশ্নাতীত এবং বাস্তবে তা সার্বিকভাবে পালিত হত। যদিও সুবার প্রশাসনিক প্রধান কাজির অপরিমিত ক্ষমতায় খুবই ঈর্ষান্বিত ছিল, কিন্তু তারা সরাসরি প্রকাশ্যে তাঁর ক্ষমতার বিরোধিতার স্পর্ধা দেখাতে পারত না, কেননা কাজি সম্রাটের কাছে প্রশাসকের বিরুদ্ধে শরিয়তি আইন বলে বিচার চাইতে পারতেন।
মুসলমান ব্যবহারশাস্ত্র অনুযায়ী কাজিকে তাঁর বিচার চালাতে হত, হয় মসজিদ বা অন্য কোন প্রকাশ্য স্থানে, বিশেষ করে শহরের জামা মসজিদটি এ কাজের জন্য আদর্শরূপে সুপারিশ করা হত। কিন্তু ব্যতিক্রমীভাবে কখোনো কখোনো তাঁর বাড়িতে বিচারের কাজ চালাতে পারতেন ঠিকই, কিন্তু জনগণকে সেখানে উপস্থিত থাকতে দিতে হত এবং বাদী-বিবাদী দুপক্ষকে বসার ক্ষেত্রে, সুযোগসুবিধে দেওয়ার বিষয়ে, এবং সাধারণ আচরণে সমতা বজায় রাখতে হত(হেদায়া)।
কাজিদের দপ্তরের কাজের নীতিনির্ধারণ বিষয়ে একটা ফরমান নিয়ে আলোচনা করতে পারি। ১৬৭১এ, সম্রাট আওরঙ্গজেব জানলেন যে গুজরাটের কাজিরা তাদের দপ্তরে সপ্তাহে মাত্র দুদিন বিচার করেন, এবং অন্য দুই দিন(মঙ্গলবার আর বুধবার) সুবাদারের দরবারে অংশ নে্ন এবং অন্য তিনদিন ছুটিতে কাটান। সেই সুবার দেওয়ানকে সম্রাট লিখলেন, ‘এইধরণের বিচারের প্রথা রাজসভায় বা অন্য কোন সুবার অনুসৃত হয় না, তাহলে গুজরাটে এ কোন যুক্তিতে এই নিয়মে কাজির দপ্তর চলবে! দেওয়ানকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তিনি যেন কাজিকে অনুরোধ করেন শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ এই পাঁচ দিন দপ্তরে বসেন, বুধবার সুবাদারের দপ্তরে থাকেন এবং শুক্রবার ছুটির দিন হিসেবে গণ্য করেন। সকালের দুই ঘড়ির(একঘন্টা) পর থেকে দুপুরের কিছু পর পর্যন্ত তিনি দপ্তরে বসে বিচার করবেন, এবং জুহর নামাজের আগে তিনি তাঁর বাড়ি যাবেন’(মিরাটিআহমদি)
(চলবে)
No comments:
Post a Comment