প্রথম খণ্ড
৬। সিংহাসনের লড়াই এবং আওরঙ্গজেবের সতর্কতা
আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদে দারার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে আরসুল শহরের চার মাইল দূরে শিবির ফেললেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, তাঁর সেনাবাহিনীর নানান চাহিদা পূরণ করতে দশ দিনের যাত্রাবিরতি দেওয়া হল। কেউ তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করত না। সত্যবাদী, সাহসী একমাত্র নাজাবত খাঁ বললেন, ‘প্রথমে আপনি যাত্রার নির্দেশ দিলেন, তারপর দীর্ঘদিন ব্যাপী শিবির গাড়ার নির্দেশ দিলেন। এতে বিপক্ষ উতসাহী করবে’। মৃদু হেসে আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আময় বল কি করে শত্রুরা উতসাহী হবে, তাঁর পরে আমি তোমার উত্তর দেব’। খাঁ বললেন, ‘যখন শত্রু আমাদের এখানে দীর্ঘ দিনের অবস্থানের খবর পাবে, তখন তারা বিশাল সৈন্য বাহিনী পাঠাবে আমাদের পথ রোধ করতে’। তিনি উত্তর দিলেন, ‘এটাই আমি চাই। আমি যদি তাড়াতাড়ি যেতাম তাহলে (দারার)গোটা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হতে হত। কিন্তু যদি আমি এখানে কিছু দিনের জন্য বসে যাই, তাহলে আমি তাদের প্রথম বাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারব। আর যদি সে নিজে নর্মদা পার করে তাহলে তাঁর অবস্থা হবে এই রকম-
যে মানুষটি তাঁর আশ্রয়, তাঁর বাড়ি ছেড়ে বহুদূর যায়,/ সে অসহায় দরিদ্র, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে,/ জলে সিংহকে মাছে খায়/ শুকনো ডাঙ্গায় কুমির খায় পিঁপড়ে।
ঠিক এই জন্যই আমি দেরি করছি, সময় হরণ করার জন্য নয়। এছাড়াও আরও একটি উদ্দেশ্য আছে, সেটি হল আমার সঙ্গে যারা (যুদ্ধে) যাচ্ছে, গরীব ধনী নির্বিশেষে তাদের চরিত্র আমি জানতে ইচ্ছুক। কোন ধনী যদি তাঁর স্বচ্ছলতার জন্য দেরি করে তাহলে তাকে আর বেশি দূর না নিয়ে যাওয়াই ভাল, কেননা ভবিষ্যতে সে বাহিনীর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আমার সঙ্গে যে সব অভিজাতরা যোগ দিতে যাচ্ছে, এবং যাদের আন্তরিকতায় আমি দ্বিমত পোষণ করছি, তারা হয়ত দেরি করবে, অমনযোগী হবে, এবং আমার শিবির থেকে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকবে, এবং যাত্রায় সেই শয়তানি দূর করা সম্ভব হবে না, হয় আমাদের তাদের ছুঁড়ে ফেলতে হবে, না হয় আমায় ফিরে আসতে হবে এবং তাদের নতুন করে বোঝাতে হবে’।
নাজাবত খাঁ এই বাক্য শুনে আওরঙ্গজেবের পদ চুম্বন করল, এবং বলে উঠল, ‘সর্বশক্তিমান জানেন কখন কাকে উচিত কাজে নিয়োজিত করতে হয়’।
আওরঙ্গজেবের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল। মির্জা শাহ নাওয়াজ খাঁ, দাক্ষিণাত্যে নিযুক্ত মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম আধিকারিক, আওরঙ্গজেবের সঙ্গে প্রথম দিনের কুচকাওয়াজে যোগ দিতে এলেন না; দ্বিতীয় দিনের কুচে তাঁর পত্র এল, ‘আমি সম্রাট শাহজাহানের বিশ্বস্ত ভৃত্য হিসেবে বলতে পারি আমি আমার সেনার সব পদ থেকে পদত্যাগ করছি। আমার দারা শুকোর সঙ্গে কোন সংস্পর্শ নেই। আমার এক কন্যা আপনার সঙ্গে বিবাহ হয়েছে, অন্য জনের সঙ্গে মুরাদ বক্সের। দারার সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই যে তাকে আমায় শ্রদ্ধা করতে হবে। মহামহিম আপনি জানেন, আমি কোন যুদ্ধে বা শিবিরে কোন কিছুতেই ভীরুতার বশ্যতা স্বীকার করি’।
উত্তরে আওরঙ্গজেব জানালেন, ‘ঠিকই, লবনের অনুগত্যর অপরিহার্যতা, তোমার মত সত্যকারের রক্তের সম্পর্কের মানুষের কাছে আশা করা যায়। কিন্তু আমি এখানে কিছু দিন শিবির ফেলে আছি। আমি কিছু দিন দৈনিক তোমায় এখানে দেখতে চাই, আর আমি যখন এখান থেকে তাবু ওঠাব তখন তোমায় ছুটি দেব। আর তুমি যদি ব্যক্তি(ফাকির) হয়ে যাও তাহলে আর তোমার জরুরত কি?’ শাজ নাওয়াজ উত্তর দিলেন, ‘এটাও এই ভৃত্যের দায়িত্বের বাইরে। আমি বংশগতভাবে সম্রাট শাহজাহানের আনুগত্য স্বীকার করেছি’।
এর পরে আওরঙ্গজেব রটিয়ে দিলেন তাঁর পেট খারাপ হয়েছে। তিনি আদেশ দিলেন, যারা তাঁকে দেখতে আসবেন, তাঁর তাঁবুতে আসবেন একা, দেহরক্ষী ছাড়াই। দ্বিতীয় দিনে যখন মির্জা শাহ নাওয়াজ খাঁ এলেন ‘অসুস্থ’ আওরঙ্গজেবকে দেখতে, শেখ মীর তাকে অবিলম্বে হাত বেঁধে গ্রেফতার করল। এবং তখনই তাঁবু তোলার নির্দেশ দিয়ে, সেই অবস্থায় তাকে হাতির হাওদায় চড়িয়ে যাত্রা শুরু করল বাহিনী। বুরহানপুরে তাঁকে কয়েদ করা হল। দারা শিকোকে হারাবার পরে জেবউন্নিসা বেগম খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলেন তিনদিনের জন্য – তাঁর অনুরোধ, তাঁর মামাদাদুকে ছেড়ে দেওয়া হোক – এবং আওরঙ্গজেব ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে মুক্তি দিয়ে আহমেদাবাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করলেন, এই সুবায় মুরাদ বক্সের পর আর প্রশাসক ছিল না। কিন্তু আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আমি মনে শান্তি পাচ্ছি না মানুষটার জন্য(তাকে বিশ্বাস করতে পারছি না), আমাকে বাধ্য হয়ে এই নির্দেশটা দিতে হয়েছে, আমি এই নির্দেশ কিছু দিন পরে নতুন করে মূল্যায়ন করব। সে সৈয়দ, ফলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া খুব কঠিন। নাহলে একটা কথা আছে, কাটা মুণ্ডু কোন গল্প বলে না।
যা আওরঙ্গজেব বলেছিলেন তাই হল। দারার সঙ্গে খাঁ যোগ দেন। আজমেরে যুদ্ধের মধ্যেই তিনি মারা যান।
মন্তব্য – আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৬৫৮তে যাত্রা করেন সিংহাসন দখলের লড়াইতে। আরসুলে তিনি একদিন থাকেন(আলমগিরনামা)। বুরহানপুরে একমাস থাকতে হয়। ‘শাহ নাওয়াজ খাঁ আওরঙ্গজেবের সঙ্গ দেন না, বহুরানপুরে নানান আছিলায় দিন কাটাতে শুরু করেন। ২২ মার্চ মাণ্ডুয়ায় পৌছন। সেখানে থেকে আওরঙ্গজেব মুহম্মদ সুলতান এবং শেখ মীরকে বুরহানপুর পাঠান শাহ নাওয়াজ খাঁকে গ্রেফতার করতে। শাহ নাওয়াজ আওরঙ্গজেবের শ্বশুর। এবং উচ্চবংশের সৈয়দ। সেপ্টেম্বরে মুলতান থেকে আওরঙ্গজেব তাঁকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং গুজরাটের সুবাদার নিয়োগ করেন। ১৪ মার্চ ১৬৫৯তে তিনি আজমেরের যুদ্ধে নিহত হন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment