চতুর্থ অধ্যায় সুবাগুলির প্রশাসন৭
৫। কোতোয়াল আর তার
দায়িত্ব
এবারে আমরা কোতোয়াল
আর তার কাজের ধরণটি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব। কোতোয়াল, শহুরে আধিকারিক, শহরের কোন
এলাকার(মহল্লা) আরক্ষা(পুলিশ) প্রধান।
কোতোয়াল পদাধিকারী
সম্বন্ধে বলা হয়েছে, যিনি বহিরাবরণে ভয়ডরহীন হয়ে আইন প্রয়োগ করেন, কিন্তু অন্তরে
ভগবত ভীত। সম্রাট বা সুবার দেওয়ান যখন বিচার করেন বা জনগণের জন্য দর্শন দেন, তখন কোতোয়াল
ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিরাপত্তা বিধান করেন। পদ গ্রহন করে কোতোয়ালের কাজ হবে
অশ্বারোহী আর সাধারণ বাহিনী নিরীক্ষণ করা; দেখা, তাঁদের বরাদ্দ পরিধান সব আছে কি
না, মালখানায় সঠিক পরিমান অস্ত্র রয়েছে কি না, এবং খাতায় লেখা পরিমান মত শেকল,
লোহার লাঠি এবং চাবুক রয়েছে কি না। তিনি নিজে জেলখানায় থাকা কয়েদিদের নিরীক্ষন
করবেন এবং তাঁদের অভাব অভিযোগ নিজের কানে শুনবেন এবং নিজে নানান অভিযোগের উত্তর খোঁজার
উদ্যোগ নেবেন। যাদের তিনি নির্দোষ ভাবেন, তাঁদের মুক্তির জন্য যুক্তি দিয়ে সরাসরি
তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখবেন এবং তাঁদের মুক্তির জন্য উদ্যোগ নেবেন। আর
যে সব বন্দীর আর্থিক অবস্থা ভাল, তাদের থেকে প্রয়োজনীয় জরিমানা আদায় করে মুক্তি
দেওয়ার উদ্যোগ নেবেন। আর্থিক সঙ্গতি নেই যাদের, তাদের সম্বন্ধে উর্ধ্বতন
কর্তৃপক্ষের থেকে আদেশ গ্রহন করবেন। যে সব অপরাধী মুক্তি দেওয়ার নয় বলে তিনি মনে
করবেন, তাদের বিশদ বিবরণ শরিয়তি আদালত আধিকারিকের দপ্তরে পেশ করবেন, এবং তাঁর
স্বাক্ষরিত নির্দেশ বলে কর্মপদ্ধতি ঠিক করবেন। যারা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য,
তাদের মামলার বিশদ বিবরণ নির্দিষ্ট আধিকারিক মার্ফত কাজির দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে
এবং মামলাগুলোতে তাকে থাকতে হবে এবং কাজির স্বাক্ষরিত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ রূপায়িত
করবেন।
পাহারাদার এবং
ঝাড়ুদারদের থেকে তিনি মুচলেকা নেবেন, যাতে প্রতি মহল্লায় তাদের কাজ তারা সম্পন্ন
করে, তারা প্রতিদিন তাঁর কাছে(হয়ত দপ্তরে) হাজিরা দিয়ে তাদের এলাকার নানান তথ্য না
লুকিয়ে অথবা না বাড়িয়ে চড়িয়ে বর্ণনা করবে। প্রত্যেক মহল্লায় তিনি পেয়াদা নিয়োগ করে
এলাকার সব খবর সংগ্রহ করবেন, এবং এই দুই পক্ষের থেকে পাওয়া বর্ণনা মিলিয়ে, সত্য
পরখ করে দেখে নিতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করতে পারেন।
‘মামলার মূল সত্য
পর্যন্ত পৌঁছে কাজির কাছে সঠিক বর্ণনা করলে মানুষ আপনাকে পছন্দ করবে। রাত ৯টা থেকে
সকাল ৯টা পর্যন্ত রাস্তায় পেয়াদা নিয়োগ করে কি ঘটছে সে বিষয়ে নজরদারি করতে হবে এবং
চোর বা দুষ্কৃতিদের গ্রেফতার করে দপ্তরে নিয়ে আসতে হবে।
‘বিকিকিনির এলাকায়,
আনন্দের স্থানে(শাদি) যেখানে প্রচুর মানুষ একত্রিত হয়, সেখানে পাহারাদার রেখে
গাঁটকাটা বা ছিনতাইবাজদের গ্রেফতার করবে এবং শাস্তি দেবে।
‘তবায়েফ, পেশাদার
মহিলা, মদ-বিক্রেতা বা মাদক বিক্রেতাদের ডেকে তাদের মুচলেকা নিয়ে তাদের বেআইনি কাজ
না করার নির্দেশ দেবে এবং তার ফলে যে নির্দিষ্ট পরিমান জরিমানা তাদের দিতে হবে সেই
হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখবে। অবাধ্যদের জরিমান করবে। মাঝরাতে অনুগামীদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে
শহরের রাস্তা পাহারা দেবে। যেসব গলির মধ্যে তোমার খবরদারেরা চোরেদের বাস বলে তোমায়
জানিয়েছে, সেখানে অঙ্কুরেই তাদের গ্রেফতার করে যে কোন দুষ্কর্মের পরিকল্পনা উপড়ে
ফেলবে।
‘কয়েদখানা কড়া নজরে
রাখবে যাতে কেউ পালাতে না পারে।
কোতোয়ালের কাজের
দায়িত্ব আইনিআকবরিতে বিশদে বলা হয়েছে। কিন্তু আকবরের সময়ে তৈরি করে দেওয়া
নীতিসূত্রগুলি তাঁর মৃত্যুর করে অনুসরণ করা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, এবং গোটা
স্তবকটি কোতোয়ালের পক্ষে কি করা সম্ভব তাঁর একটা আদর্শনীতিনির্দেশস্বরূপ, যা
বাস্তবে অনুসরণযোগ্য নাও হতে পারে। কোতোয়ালের চরিত্র আর দায় সম্বন্ধে যা বলা
হয়েছে, সেটি একমাত্র ত্রুটিহীন মানুষই অনুসরণ করতে পারে। ফলে এই সূত্রে আমি খুব
বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না।
মিরাটিআহমদিকে দেওয়া
আকবরি ফরমানে বলা হয়েছে, ...করণিকের সাহায্যে কোনো এলাকার কতগুলো বাড়ি আর প্রাসাদ
আছে, সেগুলোর হিসেব নিয়ে, তাতে কি ধরণের মানুষ থাকে, তাদের মধ্যে কারা বাজারি, কারা
শিল্পী, কারা সেনা কারা দরবেশ, দেখবে। সেই বাড়ির মালিকদের সহায়তায় বাড়িগুলির
নিরাপত্তা দেখবে এবং প্রত্যেক মহল্লায় একজন মুখিয়া নিয়োগ করবে, যার নির্দেশে নানান
কাজ সমাধা হবে। প্রত্যেক দিনেরাতে গুপ্তচর কোতোয়ালির দপ্তরে এসে কোন মহল্লায় কি ঘটছে
তা নথিবদ্ধ করবে – কোন বাড়িতে অতিথি এলে – সে নতুন বা আত্মীয়ই হোক, সে খবর মুখিয়ার
কাছে পৌঁছে যেতে হবে, কোতোয়াল প্রত্যেক বাড়ির আয়-ব্যয় জানবে, কোন বাড়ির কর্তা বেশি
রোজগার করলে কেন করছে তা জানতে হবে – তাতে ভারসাম্য বজায় নাও থাকতে পারে, বাজারে
দাম নির্ধারণ করবে কোতোয়াল যাতে একচেটিয়া ব্যবসার পরিবেশ না ঘটতে পারে। তাঁর
এলাকায় মদ বিক্রি বন্ধ করবে কোতোয়াল।
অন্যদিকে মানুচি
তাঁর দেখা কোতোয়ালের কাজ নিয়ে বিশদে বলেছেন। ‘মদ পরিশোধনের কাজ বাধা দেওয়া তাঁর
কাজ। পেশাদার বাজারি মহিলা যাতে তাঁর এলাকায় না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে, বা
সম্রাট(আওরঙ্গজেব) যে কাজ নিষিদ্ধ করেছেন, সেগুলি যাতে না ঘটে(তার এলাকায়) তা
নিশ্চিত করতে হবে। যা ঘটছে তাঁর সব খবর তাঁর কাছে থাকবে এবং তাঁর একটা সমীক্ষা তিনি
সম্রাটের কাছে পাঠাবেন। এই কাজের জন্য গোটা মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে হালালখোর(বাড়ির
ঝাড়ুদার) নামক এক ধরণের ঝাড়ুদার নিযুক্ত ছিল। তাঁরা দিনের দুবার প্রত্যেক বাড়ি
পরিষ্কার করতে যেত... এবং সেখানে কি ঘটছে তাঁর বিশদ বর্ণনা কোতোয়ালিতে দিত...কোতোয়ালের
কাজ ছিল চোর আর দুষ্কৃতি পাকড়াও করা। তিনি কাজির অধস্তন কর্মচারী, কাজির দপ্তর
থেকে নির্দেশ নিতেন তিনি...তাঁর অধীনে কিছু ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক সৈন্য ছিল,
প্রত্যেক মহল্লার জন্য একজন করে অশ্বারোহী আর ২০-৩০ জনের সেনা ছিল, যাদের কাজ ছিল
এলাকা ঘোরা।
কোতোয়াল নিয়োগের এক
সনদে তাকে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে শহরে যাতে কোন চুরি না হয় তা নিশ্চয় করতে হবে,
যাতে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত হয় এবং মানুষ নিশ্চিন্তে ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারে।
সে কাজির লিখিত নির্দেশ পালন করবে, এবং তার নিজের মতানুযায়ী কোন মানুষকে সে আটক বা
মুক্তি দিতে পারে না। শহরে যদি কোন খেয়াঘাট থাকে তাহলে সে নিশ্চিত করবে, সেখান
থেকে কোন শুল্ক যাতে কেউ না নিতে পারে(কেননা সম্রাট সেগুলি বেআইনি ঘোষণা করেছেন),এবং
মাঝি যাতে বেশি পারানি না নিতে পারে তাও দেখা তাঁর কর্তব্য, এবং দুর্নীতিগ্রস্ত
এবং অত্যাচারীরা যাতে সহজে ফেরি পার না হতে পারে সেটাও দেখা দরকার।
কোতোয়ালের দপ্তরের
সামনে একটি মঞ্চ(চবুতরা) থাকবে যেখানে অপরাধীদের বা তাদের কাটামুণ্ড প্রদর্শিত
থাকবে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment