দ্বাদশ অধ্যায়
৩। চিঠিলেখা এবং সিলমোহর করার আঙ্গিক
চিঠিলেখার আঙ্গিক নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, সম্রাট যে চিঠি বা ডেসপ্যাচেস পাঠাতেন বা তার কাছে যে সব আবেদন-নিবেদন আসত, সেগুলি দীর্ঘ, সুচিত্রিত, দলিলের মত প্রায়-অপ্রয়োজনীয়, বাগবহুল, গুণবাচক পরমতার উক্তিতে ভরপুর। মুন্সীরা আবুল ফজলের সম্রাট আকবররের উদ্দেশ্যে চিঠি লেখার আঙ্গিকটি অনুসরণ করার অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তাটি নতমস্তকে মেনে নিয়েছিলেন। চিঠি লেখার এই খারাপতম আঙ্গিকটির সঙ্গে জুড়েছিল সরকারি প্রথা অনুযায়ী মুন্সিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ বাগবহুল, গুণবাচক পরমতার নির্দিষ্টকর উক্তি – যা অনেক সময় সিংহাসনে বসা সম্রাটদের জন্য চিঠি লেখার ক্ষেত্রে অন্তত ছয়স্তবকের এবং মন্ত্রী এবং উচ্চতম আমলাদের জন্য অন্তত তিন স্তবকের বক্তব্য। প্রত্যেক সরকারি চিঠির শুরুটা ছিল হয় ‘আমি বিনীতভাবে মহামহিমকে সম্মান জানিয়ে বলতে চাই...’ বা ‘আপনার সম্মানিত সব থেকে অনুগত ভৃত্য...’ ইত্যাদি – যা আজও আমিরা অনুসরণ করে চলি, তার সঙ্গে জুড়ে থাকত যা বলার আছে সেই বক্তব্যগুলি। সাধারণত সমগ্র চিঠিটি অনুবাদ করা খুব ঝকমারি কাজ, দেখাগিয়েছে বহু পুঁথি থেকে অনুবাদকেরা ফুলেল অবোধ শব্দবন্ধগুলি বাদ দিয়ে শুরু করেছেন মি-রসনদ কে...বা জানাচ্ছি যে...থেকে...।
সপ্তদশ শতে চিঠ লেখাটা খুব কেজো কাঠ কাঠ কাজ ছিল। উচ্চতম পদের সম্রাট থেকে একেবারে সাধারণ মানুষকে সম্বোধন করতে বিভিন্ন ধরণের লব্জ ব্যবহার করা হত এবং সেগুলি বিশদে নীতিপুস্তকমালায় (ম্যানুয়্যাল) লিপিবদ্ধ করা ছিল। উচ্চতমের নির্দেশে সময়ে সময়ে সেই লব্জগুলি যখন কিছুটা পাল্টাত, সেই পরিবর্তনের নির্দিষ্ট লিখিত নির্দেশ দিতে হত কেরাণীবাবুকে। সে সময় কাউকে সর্বশক্তিমানের ছায়া বা তার সন্তান বলা হত তা খুব একটা অশোভনতা ছিল না(যেমন সম্রাটের কন্যাদের বলা হত সতীত্বের প্রতিমূর্তি বা তার সময়ের রাবিয়া বা আড়ম্বর এবং মহত্বের পিছনে থাকা ছায়া ইত্যাদি, ইত্যাদি ইত্যাদি)। তারা তাদের জীবনে খলিফা বা সর্বশক্তিমানের ছায়া হয়েই কাটাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এবং মৃত্যুর পরে বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব এবং প্রথম বাহাদুরশাহ জাফরের স্মৃতিচিহ্নকে অভিধা দেওয়া হয়েছে ফিরদৌস-মাকানি, জিন্নত-আশিয়ানি, আর্শ-আশিয়ানি, জিন্নত-মাকানি, আলা হজরত ফিরদৌস-আশিয়ানি, খুলদ-মকান এবং খুলদ মঞ্জিল – সব কটি লব্জের মানে হল বেহস্তে বসবাস করা। জীবিত যুবরাজদেরও কিছু বিশেষ উপাধি ছিল দারাশুকোহর জন্য শাহইবুলন্দ ইকবাল, শাহ আলমের জন্য মিহিরপুরীখলিফা বা মহম্মদ আজমের জন্য শাহইআলিজা ইত্যাদি। জাহানারা মৃত্যুর পরে যে সম্মানে ভূষিত হন তা হল, তার সময়ের আধ্যাত্মিক গুরু। যুবরাজ মহম্মদ আকবর, তার বিদ্রোহ আর পরে সাম্রাজ্যের আক্রমনরীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরে সরকারি নথিতে বলা হল, বাগি বা আকবরইঅবতার(অবতার মানে একদিকে হয় মহান অন্য দিকে খারাপতম)।
সম্রাট বা শাহজাদাদের উদ্দেশ্যে লেখা কোন চিঠিতে স্বাক্ষর থাকত না, এমন কি যদি খুব বড় আমলা তা লিখে থাকুক না কেন, শুধু সিলমোহর থাকত।
ফরমানের মাথায় সাম্রাজ্যের সিলমোহর থাকত, নিচে থাকত উজিরের সিলমোহর। আর বিশেষ দয়া জানাতে বা জমি দানের ক্ষেত্রে সিঁদুরে ডোবানো সম্রাটের পাঞ্জার ছাপ দেওয়া থাকত(এটা আদতে একটা থলেতে করে সম্রাটের পাঞ্জার নকল ছাপ রবারে নেওয়া থাকত, তা তার বগলের তলায় লুকোন থাকত)। শাহজাদারা সুবায় দেওয়ান থাকার সময়েও একই নিয়ম কাজ করত। যখন কোন খসড়া চিঠি/নির্দেশিকার চূড়ান্ত নকল সম্রাট অনুমোদন করতেন, তিনি সবার তলায় লিখে দিতেন সাদ(সহি বা ঠিকএর ক্ষুদ্রাংশ – আমি কয়েকটি ফরমান দেখেছি, যেখানে সম্রাট চিঠির তলায় খুব মোটা মোটা অক্ষরে সাদ লিখেছেন, তবে শব্দটা কিন্তু লেখা শেষ করেন নি, একটা টান দিয়েছেন। এর সরকারি আমলাতান্ত্রিক ব্যখ্যা হল, এর মাধ্যমে চিঠি বা নির্দেশিকা শেষ হল। আজকেও বাংলার জমিদারেরা তাদের দালাল বা ভাড়াটেদের জন্য লেখা চিঠিতে নাম লেখেন না, লেখেন শ্রী-সহি এবং সেই শব্দটা লেখা শেষ করে একটা সাপের লেজের মত আঁকাবাঁকা টান জুড়ে দিতেন। এটি মুঘল সাম্রাজের চিঠি লেখা শেষ করার অপভ্রংশ রূপ) যা তার অনুমতিসূচক। সাধারণত সম্রাট বা শাহজাদা তাদের চিঠিটির মাথার ওপরে নিজেদের হাতে লেখা কিছু স্তবক জুড়ে দিতেন, যাতে চিঠিটির আসলত্ব প্রমান হয়, বা যাকে চিঠি লিখছেন তার প্রতি তার অনুগ্রহসূচক অনুমোদন হিসেবে; আদতে এই চিহ্নগুলি ছিল, যে নির্দেশগুলি সম্রাট দিচ্ছেন, তা যেন খুব তাড়াতাড়ি পালন করে ফেলা হয়, এমন এক অব্যক্ত বক্তব্য। কিন্তু বাস্তবে চিঠিটি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছত সচিবালয়ের মুন্সির হাতে মুসাবিদা আর সুন্দর লেখকের(খুশনবিশ) হাতের লেখার নকলের পর। নানান সাম্রাজ্যিক নাম-উপাধি-যোগ বিশদে দেওয়া হয়েছে আদাবইআলমগিরিতে।
সরকারি চিঠিপত্রতে সম্রাটের(বা শাহজাদার) নাম চিঠির মূল বক্তব্য থেকে বার করে চিঠি কাগজের ঠিক মাথায় সম্মানসূচক লেখা হত, যেভাবে চিঠির শিরোনামে হিন্দুরা যে ভগবানের পুজা করেন, তার নাম স্মরণ করে চিঠি লেখা শুরু করেন। যেখান থেকে সেই নামটি তুলে নেওয়া হয়েছে, ঠি সেই জায়গায় ফাঁকা রেখে দেওয়া হত।
একটি চিঠি উপযুক্ত প্রাপকের কাছে পৌঁছলে, সেই ব্যক্তির সচিব সেই চিঠি পৌঁছবার তারিখ লিখে চিঠিটির পিছনে লিখতেন আর্জ দিদা শুদ। জমি পাওয়ার বা বিশেষ দয়া দেখানোর ফরমান বা সাধারণত কোন মধ্যবর্তীর মন্ত্রী বা সভার কোন বিশেষ অভিজাতর মাধ্যমেই অনুরোধেই করা হত, তারা সম্রাটকে প্রভাবিত করতেন। এবং এই ধরণের মাধ্যমের নাম ফরমানের পিছনে লেখা থাকত, তার সঙ্গে জোড়া থাকত রাসালাতুন(এনার মাধ্যমে হল) শব্দটি। এই প্রসঙ্গে আমি নিশ্চই বলব প্রাচীন কালের জমিদানের লিপিগুলির শেষে মধ্যশ্রেণী বা দূতকএর নাম উল্লেখ থাকত।
কোন রাজকীয় ফরমান পাওয়ার জন্য যে বিপুল সমারোহ হত, বহুদূর থেকে আসা মানুষটি সেই ফরমানটি প্রথমে তার মাথায় পরে তার চোখে বোলাবেন, সেই প্রথাটি নিশ্চই এখানে বিশদে বর্ণনার প্রয়োজন নেই।
(দক্ষিণের কিছু করদ রাজা রাজধানীর ছয়-আট মেইল দূরে ফরমান-বাড়ি বানিয়েছিলেন, তাদেরকে ফরমান পাঠানো হয়েছে জানলে তারা সেই বাড়িতে গিয়ে সেটি নিতেন।)
(চলবে)
No comments:
Post a Comment