সপ্তম অধ্যায়
ধর্ম-প্রধান, রাষ্ট্র-প্রধান
১। মুসলমান রাষ্ট্রে সম্রাটের ধর্মীয় কর্তব্য
প্রাচ্য ইতিহাসে সম্রাটেরা জনগণের ধর্মীয় গুরু হয়ে ওঠার উদাহরণ প্রচুর রয়েছে। এর
পিছনে মানবের দম্ভ বা বিচক্ষণ রাজনৈতিক জীব এবং ধর্ম প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার
অদম্য ইচ্ছে লুকিয়ে রয়েছে, এই দুটি কারণের ফলেই মানুষের মন সম্রাটের অবস্থান
প্রশ্নাতীত হয়ে ওঠে। ৫০ লক্ষ সেনার প্রধান হিসেবে কারোর মনে হতেই পারে যে তিনি তার
সাম্রাজ্যের সমস্ত মানুষের বলহীন ভালবাসা এবং সাধারণ আনুগত্য লাভ করেছেন। তিনি যে
অন্যদের মত নন এটাই তো ভাবা স্বাভাবিক, বরং তিনি সর্বশক্তিমানের খুব কাছাকাছি, এবং
তিনি ঈশ্বরের প্রতিরূপ এবং আধা-ঐশ্বরিক মানব, তাই তিনি শাসন করেন। চাটুকারেরা রোমক
সম্রাটের এবং ইংলন্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের মধ্যে এই ভাবনা সফলভাবে জাগরিত করেতে
পেরেছিল।
এই ভাবনাটা যে ইসলামি রাষ্ট্রগুলিতে সঞ্চারিত হবে এটাও
স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র এবং তার সম্রাট যেহেতু ধর্মতাত্ত্বিকভাবে চালিত হয়,
তাত্বিকভাবে সম্রাট পৃথিবীতে ভগবানের প্রতিনিধি। যুদ্ধে এবং জন-উপাসনায় বিশ্বাসীর
তিনি কমান্ডার(সেনাপ্রধান=পথনির্দেশক)। তার সময়ে তিনিই একমাত্র খলিফা। আর তিনি যদি
উপযুক্ত হন, তাহলে আরবী নবীর কাজ তার ওপর অর্ষিত হয়; তাই তিনি শুধু জাতীয় সেনাদলের
প্রধান নন, তিনি বিশ্বাসের(মুতাহিদ) একমাত্র জীবিত ব্যখাতা, এবং প্রার্থনার(ইমান)
নেতা। একমাত্র সামরিক চরিত্রের রাষ্ট্র এবং জরুরি অবস্থাই, শিক্ষিত
ধর্মতাত্ত্বিকের বদলে একজন মুখাবয়বহীন, দুর্বিনীত সেনাই মধ্যযুগ ধরে, প্রায়
প্রত্যেক ইসলামি দেশে প্রধান হিসেবে স্বীকার করেছে, ফলে রাষ্ট্র বিকাশের সুযোগ কম
থেকে গিয়েছে। দীর্ঘ শতাব্দের পর শতাব্দ ধরে, জনমানসে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে সুলতান
অবশ্যই একজন মুতাহিদ বা ইমান হবেন।২। জন আকাঙ্ক্ষায় মহামানবের আবির্ভাব
মানব হিসেবে সর্বশক্তিমানের উপাসনা(আনথ্রোপমর্ফিজম) আর্যদের প্রথম পাপ। ইসলামের মত কঠিন, কঠোর অদ্বৈতবাদী/একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুগামী হয়েও পার্সিরা এই ধারণাকে উতপাটিত করতে পারে নি। পার্সি ইসলামি বিশ্বাসে বিভিন্ন অবতারের আবির্ভাব ঘটায় ইরাণে মনুষ্যসৃষ্ট পুজার ধারণা কত গভীর তা বোঝা যায়। ব্রাউনির লিটারেসি হিস্টোরি অব পার্সিয়ায় এই ধর্মআন্দোলনএর বিশদ বর্ণনা পাচ্ছি। ইসলামি ধর্মমতাবলম্বীদের মধ্যে পার্সিদের সব থেকে বড় অবদান সুফিবাদ, সেখানেও প্রতিভাধর মহামানব পারমার্থিক নবীর(প্রেসেপ্টর) ধারণার বিকাশ ঘটেছে।
ইসলামি অতিন্দ্রিয়বাদীরা পরমতম মানবতার নাম দিলেন ইনসানিকামিল বা পূর্ণাঙ্গ মানুষ(পার্ফেক্ট ম্যান), অর্থাৎ এমন মানুষ যিনি সর্বশক্তিমানের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারেন। ইনসানিকামিল বা পূর্ণাঙ্গ মানুষ(পার্ফেক্ট ম্যান)এর ধারণা সর্বেশ্বরবাদের অদ্বৈতবাদীদের তৈরি, যারা স্বীকার করে সৃষ্টিকর্তা(অল হক) এবং প্রাণী/সৃষ্টিহওয়া(অল খালক) পরমগুণাতীত বা আল্লার(এবসোলিউট বিইং)এর পরিপুরক মুখাবয়ব/চেহারা – হিন্দুরা যাকে বলে পুরুষ আর প্রকৃতি একই ভাবনার দুটি রূপ। জনৈক আরবি অতিন্দ্রিয়বাদী লিখছেন, ‘...মানুষ, সর্বশক্তিমানের ধারণা এবং মহাবিশ্বের ধারণার সঙ্গে একইভাবে সংশ্লিষ্ট বোধ করতে পারে...সর্বশক্তিমানের বিশ্লেষণে আমরা আমাদের নিজেদের গুণান্বিত করি; তাঁর অস্তিত্বই আমাদের বেঁচে থাকা সূচিত করে...’ তিনি বিশ্বের ধ্রুবতারা(কুতব) এবং বিশ্বকে দেখার মাধ্যম রূপে সূচিত হন; তিনি সর্বশক্তমান/সর্বব্যপ্ত, তাঁর থেকে কিছুই লুকোনো যায় না, মানবতা যে তাঁর ভজনে নতমস্তক, সেটা বাস্তব এবং সর্বশক্তিমানের প্রতিনিধি(খলিফা)আর তিনি বিশ্বের ভগবান(কোরাণ)। একদিকে তিনি ঐশ্বরিক, অন্যদিকে নশ্বর মানব, তিনি সর্বশক্তিমান এবং সৃষ্টির মধ্যে সংযোগসূত্র। সনাতন(অর্থোডক্স) মুসলিমদের বিশ্বাস এই প্রতিনিধিত্বকারী মহামানব হলেন নবী মহম্মদ...অল জিলি বলছেন, প্রত্যেক যুগে মহম্মদ জীবিত সন্তের আকারে আবির্ভূত হবেন, একমাত্র অতিন্দ্রিয়বাদীদের কাছেই প্রকটিত হবেন(এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম)।
সাধারণভাবে, বিশেষ করে পারস্যের, সুফিবাদী মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা, নবি তাঁর সময়ের মানবব দেহ ধারণকারী ঐশ্বরিক শিক্ষক। হিন্দুদের ধারণায় অবতারের ধারণাটা খুব স্পষ্ট, কেননা অতীতে তাঁর রূপেই লাখে লাখে অবতার আবর্ভূত হয়েছেন, এবং যখন পাপ আর অত্যাচারের ঘড়া পূর্ণ হয়, তখন যুগধর্মেই ভগবান আবারও অবতাররূপে আবির্ভূত হবেন ঈশ্বরবিশ্বাসীদের উদ্ধার করতে(গীতা)।
No comments:
Post a Comment