ত্রয়োদশ অধ্যায়
মুঘল সাম্রাজ্য – এর অর্জন এবং ব্যর্থতা
পুরো অধ্যায়টি বাদ দিয়ে গেলাম। এর সঙ্গে বইটির শিরোনামের কোন যোগ নেই।
দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন
যদুনাথ সরকার
চতুর্দশ অধ্যায়
সূত্রের আকর
১। আইনিআকবরি, সমালোচনা
মুঘল সাম্রাজ্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সূত্রট হল আবুলফজলের আইনিআকবরি। ইতিহাস রচনায়, আঙ্গিকে, পরবর্তীকালের আধিকারিকদের লেখার আঙ্গিকে এর গুরুত্ব থাকলেও, কিন্তু এর কিছু অপূর্ণতাও রয়ে গিয়েছে। ভারতে এটি এ ধরণের প্রথম রচনা, এবং যখন মুঘল সাম্রাজ্য ধুঁকছে, নতুন করে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে, তখন এধরণের রচনা প্রশাসনক দিশা দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। তাই আবুলফজল বলেছেন, একজন আধিকারিকের কি করা দরকার, তিনি বলতে পারেন নি দীর্ঘকাল ধরে চলা এক শাসনতন্ত্রে থাকা একজন আধিকারিকের কি করা আবশ্যিক। আর তিনি তাত্বিক হিসেবে অসহ্যরকমের, যখন কোন তথ্য উপস্থাপন করতে হয়, তিনি আড়াল নেন একবোঝা সংখ্যাতত্ত্বের আড়ালে এবং সেটাও হয়, সেটাও হয় এমন অনুভূতি উপস্থাপন করেন। ফলে তাঁর কাজ আমাদের সে সময়ের প্রশাসনিক পরিকাঠামোর সঠিক চরিত্র উপস্থাপন করে না, যদিও সংখ্যাতত্ত্বে তিনি বিশদ এবং যথাযথ। আইনিআকবরির বিভিন্ন বর্ণনাত্মক অধ্যায়ে নানান ধরণের অস্পষ্টতার এবং অবাস্তবতার চিত্র দেখার অনুভূতি হয়।
ডব্লিউ ক্রক লিখছেন, ‘মুঘল আমলের এই সর্ববিদ্যাবিষয়ক বইটিত যেই পড়তে যাবেন, তিনি অনুভব করবেন প্রেক্ষিতের অভাব। আকবর বিশদ বর্ণনার গুরু ছিলেন, সেই বিশদে যাওয়ার প্রবণতাটি আইনে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন শিবির এবং প্রাসাদের বিশদ বর্ণনা রয়েছে, আস্তাবল থেকে পোষাকের আলমারি, অস্ত্রাগার থেকে শিকারের অস্ত্রশস্ত্র পর্যন্ত...কিন্তু আজকে আমরা যাকে প্রশাসন বলতে বুঝি, আরক্ষা, বিচার সেবা, প্রাকৃতিক সম্পদের বিকাশ, মন্বন্তর-ত্রাণ, বা শিক্ষা বা চিকিৎসা ব ব্যবস্থা, তা পাইনা’। ‘আইনিআকবরির তথ্যগুলিতে কতটা বিশ্বাস করা যায় তা বলা দুষ্কর...রাজস্ব তথ্য বিষয়ে এই প্রশ্নটা করা যায়, সেটা হল, যেটা বলা হয়েছে সেটা কি, কতটা আদায় করা যাবে তার আদর্শগত হিসেব, না কতটা আদায় করা হয়েছে তার বাস্তব হিসেব’।
অবাস্তব, বাস্তবিক আকামের বই, এবং তার বিষয়বস্তুটি এতই বেহুদা যে আইনিআকবরির পরে আকবরের উত্তরাধিকারীরা এই ধরণের বই লেখার খুব বেশি উৎসাহ বোধ করান নি। তাদের দপ্তর বোঝার কাজে যে নীতিবইটি কাজে দেয়, তার নাম দস্তুরউলআমল, ঠিক যেন আবুল ফজলের লেখার আঙ্গিকের তাত্ত্বিক বিরোধে বইটি তৈরি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সারাংশ, তথ্যে ভাণ্ডার, তথ্য এবং তালিকা, বর্ণনাহীন তথ্য এবং বহু স্থানে বাক্য শেষই হয় নি। এই ধরণের ছোট্ট কার্যকর পুস্তক প্রায় প্রতিটি সম্রাটের রাজত্বকালে সম্পাদনা করা হয়েছে। প্রত্যেক সম্পাদনা কালে বইটির প্রতেক পরিচ্ছদে নতুন তথ্য যোগ হয়েছে যাতে তথ্যগুলি সময় সাপক্ষ থাকে।
এই পুস্তকটি শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেবের সময় লিখিত হয়, এবং সে সময়ে বহু পাণ্ডুলিপি আজও পাওয়া যায়। টমাস এগুলির পাঁচটি ব্যবহার করেছেন, আমি ইন্ডিয়া অব আওরঙ্গজেবঃ স্ট্যাটিস্টিক্স, টপোগ্রাফি এন্ড রোড গ্রন্থ লিখতে অন্যান্য সূত্র ছাড়াও এই পাঁচটির মধ্যে একটি(এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের) পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করেছি।
তবে ভালটি আমি নিজে নকল এবং পড়াশোনা করেছি। তার মধ্যে একটি রয়েছে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে ৩৭০ নম্বর, যার সামনে পিছনের পাতা নেই। আরেকটি রয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে, ওরিয়েন্টাল নম্বর ১৬৪১, পুরোটা রয়েছে, কিন্তু চিহ্নিত হয়েছে যাওয়াবিতইআলমগিরি বা আওরঙ্গজেবেত সময়ের নীতি নামে। নাম আলাদা হলেও দুটি একই পাণ্ডুলিপি, সেগুলি ভিন্ন পাণ্ডুলিপি থেকে অনুদিত হয়েছে। দুটিই সম্রাটের ৩৩ তম রাজত্ব বছর – যখন বিজাপুর, গোলকুণ্ডা এবং মারাঠা রাজধানী রায়গড় দখল করে দিল্লির অধীন করে মুঘল সাম্রাজ্য এবং সেই সময় পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য দেয়। অষ্টাদশ শতের মধ্য পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য ভাণ্ডার পাওয়া যাবে জগজীবন দাস এবং রায় চন্তরমল্লের কাজে, যেগুলির অনুবাদ আমি করেছি ইন্ডিয়া অব আওরঙ্গজেবএ।
এই দস্তরউলআমল বা সরকারি নীতিমালা(হ্যাণ্ডবুক) পুস্তকে খুব কম কথায় বলে বিভিন্ন সুবার রাজস্ব, বিভিন্ন বিভাগের সংখ্যা, রাজত্বের বিভিন্ন শহরের দূরত্ব, রাজসভায় সরকারি নথিপত্র পাঠাবার প্রক্রিয়া, যে সব নথি বিভিন্ন দেওয়ানের দপ্তরে আসা দরকার, রাষ্ট্রের মোট খরচ, মনসবদারদের সংখ্যা এবং অন্যান্য সেনাবাহিনী, মুসলমান এবং হিন্দু অভিজাতদের সাধারণ উপাধি, সঙ্গীতকার এবং লিপিকারদের নাম, বক্সী আর দেওয়ানদের কাজের বিভাগ, খানইসামান, বুয়ুতাত, মীর আতীশ, বরকন্দাজদের মুশরিফ সহ অন্যন্য বিশেষ বাহিনীর কাজ এবং দায়-দায়িত্ব, আহদির বক্সীরদের কাজ এবং দায়িত্ব, প্রধান দেওয়ানের দপ্তরের বিশদ বিবরণ এবং তাঁকে কোন কোন দপ্তর কি কি নথি পাঠাবে, কিভাবে সংগ্রহ করবে, কোন নথি উত্তর দেবে, তৈরি এবং স্বাক্ষর করে সম্রাটের কাছে জমা দেবে তার বর্ণনা, শাহজাদা এবং মনসবদারদের নগদ বেতন দেওয়ার নিয়ম, অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়া নাল পরানো এবং ঘোড়ার গায়ে ছাপমারার নীতি, ছুটি পাওয়া আর ছুটি বাড়ানোর নীতি, অস্ত্র অনুযায়ী আধিকারিকদের শ্রেণী বিভাগ, আধিকারিক শ্রেণীর কাউকে জাগিরপদ দেওয়ার বিশদঅনুপুঙ্খ তথ্য রাখা(মিনিট), অনুচরদের বেতন, বিভিন্ন মনসবদারের যানবাহনের পশুখাদ্য বিষয়ক ইত্যাদি।
তারপরও আছে ওজনের তালকা(বর্তমান সময়ের বিভিন্ন এলাকার), ভারতের বাইরের দেশগুলির মুদ্রার বিনিময় মূল্য, সাম্রাজ্যের দুর্গ, বিভিন্ন শ্রেণীর মনসবদার, পদোন্নতির নীতি, পদচ্যুতি এবং রোগের ছুটি – অরায় সব ধরণের বেতন বিষয়ক নীতি, ইওরোপিয় বন্দুকবাজ, গোলান্দাজ এবং স্যাপার্স(খনি শ্রমিক?)দের বিশেষ বেতন, বন্দুকের বারুদ সরবরাহ, বিভিন্ন অস্ত্রের শ্রেণীবিভাগ, জাজিয়ার হার, সমুদ্রে যাওয়ার উচিত মরশুম, বিভিন্ন শাহজাদা, অভিজাতদের দখলি সম্পত্তি, পারস্য থেকে প্রাপ্ত উপহার, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ধনাগার, কারখানাগুলির তালিকা, যে সব আবওয়াব আওরঙ্গজেব নিষিদ্ধ এবং বেআইনি ঘোষণা করেছেন, বিজাপুর, গোলকুণ্ডা ইত্যায়াদি দখল করার জন্য শস্ত্রাদি, দাক্ষিণাত্যের কিছু দুর্গের বর্ণনা, এবং সম্রাটের দাক্ষিণাত্য বিজয়, রাজ্য সম্পর্কে নানান তথ্য।
ওপরের বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, কি বিশাল পরিমান উপযোগী তথ্য ঠুসে দেওয়া হয়েছে দস্তুরউলআমলএ। কিন্তু দুটো যে পাণ্ডুলিপি বললাম সেগুলি খুব খারাপভাবে লেখা হয়েছে।
আনন্দের কথা হল, পরবর্তী কাজে আমরা দস্তুরের অনুলিপি এবং সঠিক তথ্য পাই ইন্দো-পার্সি সাহিত্যে যা খুব ব্যতিক্রমী বলা যায়। সুবার দেওয়ান আলি মুহম্মদ খাঁয়ের লেখা মিরাটিইআহমদি বা গুজরাটের ইতিহাস লেখা শেষ হয় ১৭৬১ সালে। লেখক তার দপ্তরে রাখা প্রায় প্রত্যেক আধিকারিককে লেখা সরকারি ফরমানের বিশদ নকল দিয়েছেন সেই পাণ্ডুলিপিতে। এই প্রথম মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনের সঠিক বিশদ বর্ণনা পাওয়া গেল কোন ইতিহাস বইতে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment