প্রথম খণ্ড
৮। আওরঙ্গজেবের ইচ্ছে পত্র
সর্বশক্তিমানের যারা অনুগামী, যারা তাঁর পরিতুষ্টি প্রদান করেছেন তাদের ওপর তার দোয়া ঝরে পড়ুক। আমার শেষ ইচ্ছের নির্দেশাবলী দিয়ে যেতে চাইঃ
প্রথম – এই পাপী এবং অন্যয়পর মানুষটির হয়ে হাসানের পুণ্য কবরে চাদর দেবে, কারণ যারা পাপের সমুদ্রে ডুবে রয়েছে তাদের করুণা আর কৃপার দরজা দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এই মঙ্গলকর কর্মটি(ইচ্ছা পত্র রচনাটি) আমার মহৎ পুত্র শাহজাদা আলিজা(মহম্মদ আজম)র উপস্থিতিতে করছি।
দ্বিতীয় – ফেজ টুপি সেলাই করে যে চার টাকা দু আনা রোজগার করেছিলাম, সেটি মহলদার আয়া বেগের জিম্মায় রাখা আছে। সেটা অবহেলিতদের কবরে শবচ্ছেদ দেওয়ার কাজে ব্যবহার করবে, কুরাণ নকল করার শ্রম রূপে তিনশ পাঁচ টাকা আমার নিজের তবিলে রয়েছে নিজের ব্যক্তিগত খরচের জন্য। আমার মৃত্যুর দিন সেগুলি ফকিরদের দান করে দিও। শিয়ারা যেহেতু কুরাণ নকল করা বেআইনি স্বীকার করে, এই টাকাক’টি দিয়ে আমার কবরের আচ্ছাদন কিনে দিও না।
তৃতীয় – শাহজাহা আলিজার মধ্যস্থ থেকে আমার শেষকৃত্যর বাকি কিছু নিও, সেই আমার খুব কাছের সন্তান, আমার শেষকৃত্যর আইনি বেআইনি কাজ তাঁর ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে। এই অনুপায়(আওরঙ্গজেব) ব্যক্তি সেই কাজগুলোর জন্য জবাবদিহি করতে থাকবে না, কেননা মৃতেরা তার উত্তরপুরুষের হাতে থাকে।
চতুর্থ – ঠিক পথে চলতে চলতে (পথ ভুল করে)বিপথের উপত্যকায় গিয়ে পড়া এই ভ্রমণকারীকে মাথা খালি রেখেই কবর দিও কেননা, ছারখার হয়ে যাওয় প্রত্যেক পাপী, খালি মাথায় সর্বশক্তিমানের সামনে উপস্থিত হলেই অনুকম্পা অর্জন করে।
পঞ্চম – আমার কবরে দেওয়া কফিনের মাথাটি গাজি কাপড় দিয়ে আচ্ছাদন দিও। কবরে কোন ঢাকাঢুকি দিও না, আর সে সময় বিধর্মীয় কোন গানবাজনা কোর না বা সাদাসিদা নবীর মাওলাদ দেখিও না।
ষষ্ঠ – এই সাম্রাজ্যের শাসকের(আমার উত্তরাধিকারীর) একটু কাজ করা উচিত, যারা এই দুর্বিনীত হতভাগ্যের(আওরঙ্গজেব) সঙ্গে মরুভূমি, জঙ্গলে(দাক্ষিণাত্যে) ঘুরেছে, তাদের ক্ষমা এবং দোয়া প্রদর্শন করবে। এমনকি তারা যদি কোন ভুলও করে থাকে, উত্তরে তাদের দয়া উপহার দাও এবং (তাদের ভুলগুলি)মার্জনা কর।
সপ্তম – হিসেব রাখার(মুতাসাদ্দি) কাজে পারসিদের থেকে উত্তম আর এই বিশ্বে কেউ নেই। এবং যুদ্ধতেও, সম্রাট হুমায়ুনের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত, কোন দেশ তাদের থেকে উত্তম হতে পারে নি, এবং তাদের জমিতে দাঁড় করানো পদদ্বয়কে নড়াতে পারে নি। সব থেকে বড় কথা তারা তাদের প্রভুর বিরুদ্ধে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে নি। তাদের আশা শুধু সম্মান পাওয়া। কিন্তু তাদের সঙ্গে চলা খুব কঠিন। যে কোনভাবেই হোক তাদের ঠিক পরামর্শ দেবে, এবং তাদের আলাদা আলাদা করে নিয়োগ করবে।
অষ্টম – তুরানীরা সেনা। তারা লড়াই, পিছু নেওয়া, শক্তিপ্রয়োগ করা, রাতের আক্রমণ এবং গ্রেপ্তারের কাজ ভাল পারে। যুদ্ধের মাঝ পথ থেকে কখোনো হঠাতই যদি পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে তাদের কোন সন্দেহ, অসম্মান বোধ হয় না, এর অর্থ ‘ছোঁড়া তীরকে তুমি ফিরিয়ে নিতে পার’ – এবং হিন্দুস্তানিদের মুর্খতার থেকে তারা বহু দূরে বসবাস করে, যারা(হিন্দুস্তানিরা) মনে করে মাথা চলে যাক তবু (যুদ্ধ থেকে) পিছু হঠব না। এই জাতিকে যথাযথ সম্মান দেবে, কেননা অন্যেরা যা পারবে না, তা তারা করে দেখায়।
নবম – বাহারার সৈয়দদের যথোচিত সম্মান দেখাবে, কেননা তারা(নবীর পরিবারের) আশীর্বাদ ধন্য, কুরাণের পুণ্য কবিতায় বলেছে, নবীর কাছের সম্পর্কের মানুষদের তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু দিতে হয়, কখোনোই তাদের সম্মান দিতে বিলম্ব করবে না। পবিত্র কবিতায় বলা হয়েছে, আমি বলছি, এর বিনিময়ে (নবীর)আত্মীয়দের ভালবাসা ব্যতীত তুমি কিন্তু কোন প্রতিদান আশা কোরো না, এই পরিবারের প্রতি ভালাবাসা হল নবীতার প্রতি এওয়া তোমার খাজনা, এবং এই বিশ্বে এর থেকে প্রয়োজনীয় ভালবাসা আর কিছুই নেই। কিন্তু বারহার সৈয়দদের প্রতি সম্পর্ক করতে চরমতম সতর্ক থেকো। তাদের মন দিয়ে ভালবাসবে না, তাদের এমনভাবে পদন্নোতি করবে না, যাতে তারা সাম্রাজ্যের নানান বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেটা দেখবে; এবং তাহলে তারা সাম্রাজ্যটাও চেয়ে বসতে পারে। তাদের যদি একটুও ছাড় দাও তারা তোমার সম্মান হানি করাবেই করাবে।
দশম – সম্রাটকে তার সারা সাম্রাজ্য ঘুরে বেড়াতে হবে; সে যেন এক জায়গায় বসে না যায়, তাতে হয়ত তার বিশ্রাম হবে, কিন্তু(সেই বিশ্রাম) ভবিষ্যতে হাজারো দুর্দশা আর উপসর্গ বহন করে আনবে।
একাদশ – তোমার পুত্রদের বিশ্বাস করবে না। তোমার জীবনকালে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করবে না। যদি সম্রাট শাহজাহান দারা শুকোর প্রতি যদি এই আচরণ না করতেন, তাহলে হয়ত বৃদ্ধাবস্থায় তাঁকে এই দুঃখের মখ্যে কাটাতে হত না। চিরাচিরিত প্রবাদটি মনে রাখবে ‘রাজার কথা শুকনো হয়’।
দ্বাদশ – রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভটা হল, রাজ্যের ঘটে চলা ঘটাবলীর সঙ্গে সবসময় ওয়াকিবহাল থাকা। একটা মুহূর্তও যদি তুমি গাফিলতি কর, সেই অসম্মান তোমায় দীর্ঘদিন বয়ে চলতে হবে। শয়তান শিবা(শিবাজী)র মুক্তি ঘটেছিল আমার অসতর্কতায়, আমায় শেষ জীবন পর্যন্ত তার প্রতিদান চোকাতে হয়েছে(মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে করে)।
বারো সংখ্যাটি আশীর্বাদক। আমি এই বারোটি নির্দেশ দিয়ে আমার ইচ্ছে পত্র সমাপ্ত করলাম।
(কবিতা) তুমি যদি পড়াশোনা কর, শেখ, জ্ঞানকে চুম্বন করবে,/ আর যদি অবহেলা কর তাহলে হায় হায় হায়।
শিয়াদের মধ্যে অধিকাংশ দ্বাদশ ইমাম অনুসরণ করেন, তাই তাদের বলা হয় ইনসাআসারি(দ্বাদশা); একটি ছোট অংশ প্রথম সাতটি অনুসরণ করেন, তাই তাদের সাবিয়া(সাতিয়া) বলা হয়। তুর্কদের বারো বছরের চক্র রয়েছে।
(প্রথম খণ্ড সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment