দশম অধ্যায়
৪। কিছু কারখানা
সপ্তদশ শতের মাঝখানে ফরাসি চিকিতসক, বার্নিয়ে মুঘল রাজধানী ভ্রমনকালে কয়েকটি কারখানার কাজকর্ম দেখেন। তিনি লিখছেন, দুর্গের মধ্যে ‘বহু জায়গায় বিশাল কক্ষ রয়েছে, যেগুলির নাম কারুশিল্পীদের কারখানা। একটি ঘরে তাদের গুরুর তত্ত্বাবধানে সূচীশিল্পীরা কাজে ব্যস্ত। দ্বিতীয় কক্ষে দেখা যাবে স্বর্ণশিল্পীরা কাজ করছে। তৃতীয়টিতে চিত্রশিল্পীরা, চতুর্থতে বিভিন্ন দ্রব্যে বার্ণিশ লাগানো হচ্ছে, পঞ্চমটিতে জোড়াদার, কুম্ভকার(টার্নার), দর্জি, মুচি কাজ করছেন, ষষ্ঠতে রেশম, কিংখাব, খুব সুন্দর মসলিন দিয়ে শিরস্ত্রান তৈরি হচ্ছে, সোনার ফুল দিয়ে মালা তৈরি হচ্ছে, রুচিসম্মত সূচিশিল্পে মণ্ডিত মেয়েদের পোষাক তৈরি হচ্ছে।
‘প্রত্যেক সকালে কারু শিল্পীরা সারাইএর কাজ করেন, এবং সারাদিন তারা কাজে নিযুক্ত থাকেন, রাতে বাড়ি ফিরে যান...সূচিশিল্পী তার পুত্রকে সূচিশিল্পী হিসেবে তৈরি করেন, স্বর্ণকারের পুত্র স্বর্ণকার হন, শহরের চিকিৎসক তার পুত্রকে চিকিৎসক হিসেবেই গড়ে তোলেন। তার গোষ্ঠীর পেশার বাইরে কেউ বিবাহ করে না, এই প্রথা হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েই কঠোরভাবে পালন করেন’।
সুবায়, লাহোর, আগ্রা, ফতেপুর এবং আহমেদাবাদ আর বুরহানপুর আর কাশ্মীরে কারখানা রয়েছে। সুবার দেওয়ানেরা এই কারখানা চালাতে পারেন না(খুব ছোট আকারে ছাড়া), কেননা তাদের বদলির চাকরি। কিন্তু তারা স্থানীয় কারু ও বস্ত্র শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, কেননা আশিকারিকরা সম্রাটের খেয়ালখুশির চাহিদা আর নমুনা অনুযায়ী পণ্য পাঠাতে বাধ্য। ‘সম্রাট এবং যুবরাজ তাদের তরফ থেকে কিছু পদাধিকারীকে সুবায় রাখতেন যাতে তারা সেই অঞ্চলের সবথেকে ভাল জিনিসটি তাদের তৈরি করে দেওয়া যায়। ফলে তারা স্থানীয়ভাবে কারি শিল্পীরা কি কি ভাল দ্রব্য তৈরি করছেন, তার দিকে সব সময় তাকিয়ে বসে থাকতেন’।
আবুল ফজল বলছেন, কিভাবে রাষ্ট্রীয় মদতে কারু শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল, ‘মহামহিম বিভিন্ন কারু শিল্পীর আর শিল্পের দিকে নজর দিতেন...শিল্পগুরু আর কর্মীরা যাতে এই দেশে বসবাস করেন, এবং পরের প্রজন্মকে তদের অধীত বিদ্যা শেখান তার জন্য তিনি উৎসুক থাকতেন। ফতেপুর আগ্রা লাহোর আহমেদাবাদ-গুজরাটএর কর্মশালার শিল্পগুরুদের হাত থেকে অসম্ভব কিছু শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়েছে; যে মূর্তি, কারুকার্যের নকশা, যে মোচড়, বা বিভিন্ন কেতা(ফ্যাশান) তারা উদ্ভব করেছেন, এবং যা আজও চোখে দেখা যায়, তা ভ্রমনকারীদের হতবাক করে দিয়েছে...আর এই কারু শিল্পীদের প্রতি যে কেয়ার আমরা নিচ্ছি, তাতে আগামী দিনে এঁদের উতকর্ষ আরও বৃদ্ধি পাবে...অন্যান্য দেশে যেসব জিনিস দিয়ে কারু কাজ করা হয়, আমরা আমাদে শিল্পীদের সেই দ্রব্যও যোগান দিচ্ছি। সুন্দর দ্রব্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে ধরণের সূক্ষ্ম বস্ত্র আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে, তা যে কোন বর্ণনার অতীত হয়ে পড়ছে’।
গোলকুণ্ডা রাজ্যের মুসলিপট্টমের ক্যালিকো ছাপা বহুকালের বিখ্যাত ছিল, এবং দাক্ষিণাত্য বিজয় করে এক চিঠিতে ইচ্ছে প্রকাশ করে বলেন যে সেখান থেকে যাতে কিছু ক্যালকো ছাপার কারিগর দিল্লি আগ্রার রাষ্ট্রীয় কারখানাগুলিতে পাঠানো যায় তার ব্যবস্থা করতে। এটা সাধারণত শ্রমিকদের চাপ দেওয়া।
বহু শ্রমিক এই ব্যবস্থায় খুশি ছিল না, এবং তার জন্য দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটে নি। ভারতের ধনীতম শহর ছিল দিল্লি। কিন্তু সেখানে কোন শিল্পী তার নিজের উদ্যোগে কারখানা বানাতে পারত না। বার্ণিয়ে বলছেন, ‘যদি কারু শিল্পীদের সঠিক উৎসাহ দেওয়া হয় তাহলে সূক্ষ্ম শিল্পের বিকাশ ঘটতে পারে; কিন্তু এই অখুশি মানুষদের খাঁচায় যেন পুরে রাখা হয়েছিল, তদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা হত, এবং তাদের বেতনও ছিল তুলনায় কম। ফলে একজন ধনী খুব কম ব্যয়ে তার বিলাসদ্রব্য পেয়ে যান। যখন কোন উমরা বা মনসবদার কোন শিল্পীকে দিয়ে আজ করাতেন, তখন গোটা বাজারটা তার কাছে পাঠাতেন, আর তার সঙ্গে পাঠাতেন বাহিনী যাতে তিনি চাপে থাকেন, এবং যখন তার কাজ শেষ হয়ে যায়, সেই শিল্পীর (সৃষ্টির পারিশ্রিমক তো বাদই দিলাম) শ্রমের মূল্যটুকুও পেতেন না, কাজ শেষ হয়ে গেলে যা পেয়েছেন, তা হাতে নিয়ে ভাবতেন, যাক আজ ভাগ্যভাল, শ্রমের মূল্য হিসেবে পিঠে বেশি চাবুকের মার পড়ল না। ...ফলে কোন শিল্পী এই অবস্থায় কি করে উদ্ভাবনের শক্তির বিকাশ ঘটে! ... একমাত্র যে সরকারি কারখানার শিল্পী সম্রাট বা কোন শক্তিশালী উমরার কাজ করছেন, তিনিই পরিচিতি পেয়েছেন’।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment