দ্বাদশ অধ্যায়
চিঠ আর সিলমোহরের দপ্তর
১। কিভাবে সচিবেরা চিঠি সংগ্রহ করতেন
মুঘল সাম্রাজ্যে চিঠিপত্র বিভাগ(দারউলইনসা) খুব বড় এবং বিস্তৃত ছিল, এই দপ্তরের যেসব কাগজপত্র বেঁচে গিয়েছে সেগুলি ইতিহাসের ছাত্রদের ইতিহাস রচনায় অভূতপূর্ব সাহায্য করেছে। আওরঙ্গজেব বা তাঁর পরবর্তী রাজসভা সময়ে বা রাজসভার বাইরে ফেলা তাঁবু থেকে বিভিন্ন করদ রাজাদের এবং বিভিন্ন সুবার রাজপ্রতিনিধিকে পাঠানো আখবার বা ইস্তেহারও (নিউজবুলেটিন) প্রথম শ্রেণীর তথ্যের আকর হিসেবে, কোন সন্দেহই নেই, ঐতিহাসিকদের অমিত সাহায্য করেছে। কিন্তু আওরঙ্গেজেবের সময়কে বুঝতে গেলে তাঁর সময়ে লেখা চিঠিগুলির সঙ্গে যদি পূর্বে উল্লিখিত আখবারের নানান তথ্য মিলয়ে পড়া যায়, তাহলে সেগুলি তাঁর সময়ের ইতিহাসের তথ্যাবলীর অন্যতম আকর রূপে গুরুত্ব পাবে। এই চিঠিগুলি কোন সম্রাট বা কোন মহাফেজখানা সংরক্ষণ করে নি, বরং বিভিন্ন ব্যক্তি, বিশেষ করে সচিব(মুন্সী), যারা এই চিঠিগুলির মুসাবিদা করতেন, তাদের সূত্র থেকে পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যেকে তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কি লিখছেন, তাঁর প্রত্যেকটির নকল রাখতেন, এবং পরের দিকে এগুলি একত্রে মিলিয়ে, সঠিক মুখবন্ধ সহ, খণ্ডের শেষ পৃষ্ঠা সহ একএকটি খণ্ডে বাঁধিয়ে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করেছিলেন; আমি যা বলতে চাইছি তা হল, তারা সেই চিঠিগুলি পড়া এবং সেগুলির নকল করার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, যেহেতু, সে সময় ছাপাখানার ভাবনা দূরঅস্ত ছিল। বহু সময়ে দেখা গিয়েছে এই চিঠির বইগুলি সেই মুন্সির পুত্র বা ভক্ত-বন্ধু সেই মৃত মুন্সীর সাহিত্য হিসেবে সংরক্ষিত করে রেখেছেন। যখন এগুলি ছাপা হল, এগুলি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিঠিসাহিত্যের অনুলিপি হিসেবে নকল হতে শুরু হল। আজও সেই সব কিছু কিছু চিঠি পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু যেসব চিঠির খণ্ডতে এইগুলি রাখা ছিল সেগুলির অনেকটাই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ঐতিহাসিক মূল্যযুক্ত বহু আলগা হয়ে পড়া থাকা চিঠি একখনও কোন সংগ্রহে অন্তর্ভূক্ত হয় নি(হয় সেগুলি একই মানুষের লেখা ছিল না, বা এত চিঠি লেখা হত, সবগুলিকে খণ্ডে সংগ্রহ করা হয়ত সম্ভব ছিল না)। সেই চিঠিগুলি বেঁচে গিয়েছে।
এই চিঠির বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যক মূল্যের জন্য, কিন্তু তাঁর ঐতিহাসিক মূল্যের জন্য নয়। মুন্সিরা সেই সময়ে ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক হয়ে উঠবেন, এটা সেসময় ভাবা যায় নি, কিন্তু তাদের সময়ের মার্জিত সমাজ নিজেদের মত করে ভেবেছিল, কি করে তাঁদের এই দক্ষতাটাকে কাজে লাগানো যায়। তাদের উদ্দেশ্য এমন ছিল না যে, ঐতিহাসিক তথ্য ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রহ করা দরকার, বরং, অলঙ্কারশাস্ত্রের চিঠবিদ্যা সংক্রান্ত ছাত্রদের চিঠি লেখার দক্ষতা, মুসাবিদার ঐশ্বর্য বাড়াবার/শেখাবার জন্য এই খণ্ডগুলি বারবার ব্যবহার করেছে সেযুগের মার্জিত সমাজ। বহু মুন্সি, তাঁর পরিবারের উত্তরাধিকারীদের পেশা হিসেবে চিঠি লেখার দক্ষতা শেখাবার জন্য এই চিঠিগুলি বংশপরম্পরায় সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন। বাস্তবিক, প্রত্যেক মুন্সিই, পার্সি বয়েত বা সরস শ্লেষাত্মক ক্ষুদ্র কবিতা লেখার জন্য প্রখ্যাত ছিলেন, এবং প্রত্যেক চিঠিতে আরবি অক্ষরে তারা সেই সময়ের নানান ঘটনার এবং সময়ের স্বাক্ষর পেশ করতেন।
কিছু চিঠির সংগ্রহ আজ চিঠিলেখার কায়দাকানুনের পাঠ্যপুস্তক হিসেবেগণ্য হতে পারে। চিঠিগুলি শুরু হয় পদ্য ছন্দে কলমের স্তুতি বা চিঠি লেখার স্তুতির(ইনশা) মধ্যে দিয়ে, তাঁর পরে অক্ষর উদ্ভব আর বিকাশের পৌরাণিক গল্প দিয়ে, এবং বিভিন্ন লেখনির আঙ্গিক এবং তাঁদের পূর্বপুরুষের স্তুতি দিয়ে; তাঁর পরে শুরু হত চিঠির বয়ান। তবে এই চিঠির বইগুলি কিন্তু এমন সময়ের প্রামান্য চিঠির উদাহরণ যখন বলা যায় মুঘল রাজসভা তাঁর ঐশ্বর্যমণ্ডিত ঐতিহাসিকতাকে পিছনে ফেলে এসেছে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment