প্রথম খণ্ড
৪। পুত্রদের প্রসঙ্গে
সম্রাট শাহজাহান মাঝে মাঝে বলতেন, ‘আমার প্রথম পুত্র(দারা শুকো) ভাল মানুষদের শত্রু করে তুলছে; মুরাদ বক্স মদ খেয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে; মহম্মদ সুজার ভালত্ব ছাড়া আর কোন গুণ নেই। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সঙ্কল্প আর বুদ্ধিমত্তা প্রমান করেছে, সেই একমাত্র এক দুর্যোগপূর্ণ কাজটি(ভারত শাসন) সামলাতে পারবে। কিন্তু তার রোগভোগ আর দৈহিক অস্বাস্থ্য আমায় চিন্তায় ফেলেছে।
(কবিতা) তাহলে তিনি আর কাকে বন্ধু বলে ভাবতে পারেন/ এবং কাকে তিনি তার হৃদয় দিয়ে যাবেন।
৫। জয়নাবাদীর সঙ্গে প্রেম
জয়নাবাদীর সঙ্গে প্রেম হয়েছিল এই প্রকারেঃ
দাক্ষিণাত্যে তাকে সুবাদার করার পর তিনি তার সদর আওরঙ্গাবাদের দিকে যাচ্ছিলেন, বুরহানপুরে তিনি পৌছলেন, সেখানের শাসক ছিলেন সাইফ খাঁ(যিনি আসফ খাঁয়ের কন্যা, শাহজাদার মামি, সালিহা বানুকে বিয়ে করেছিলেন। তার সঙ্গে আওরঙ্গজেব দেখা করতে গেলেন। সালিহাও তাকে নেমন্তন্ন করলেন। তার মামির প্রাসাদে, আওরঙ্গজেবের চোখের সামনে থেকে হারেমের কন্যাদের দূরে রাখার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করে নি। এবং আগমন বার্তা সূচিত না করেই শাহজাদা প্রাসাদে পৌছলেন। জৈনাবাদীর পিতৃদত্ত নাম হীরা বাঈ। তিনি তখন একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিলেন ডান হাতে গাছের একটি ডাল ধরে, আর নিচুস্বরে গান গাইছিলেন। তাকে দেখেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে শাহজাদা সেখানেই শুয়ে পড়লেন মূর্ছা যাওয়ার মত করে। সেই সংবাদ তার মামীর কানে পৌঁছল। প্রাসাদে খালিপায়ে ছুটতে ছুটতে এসে তিনি আওরঙ্গজেবকে তার বুকে তুলে নিয়ে কান্না শুরু করলেন দীর্ঘস্বরে। শাহজাদা তার জ্ঞান ফিরে পেলেন ৩ বা ৪ ঘড়ির পর। এবারে তিনি তাকে প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে দিতে শুরু করলেন, ‘এই রোগটা তোমার হল কি করে? এরকম মুর্ছা কি তুমি এর আগে গিয়েছ’? ইত্যাদি। শাহজাদা চুপ করে থাকলেন কোন উত্তর না দিয়ে। আনন্দ, বিনোদন, আতিথেয়তা আর উচ্ছ্বাস সব নষ্ট হয়ে গেল। সক্কলেই কেমন থম মেরে গেলেন। মধ্যরাত্রে শাহজাদা ফিরে পেলেন তার বাক্যশক্তি। ‘আমি যদি আমার রোগ বলি তাহলে আপনি কি তার নিদান দিতে পারবেন’? এই বাক্য শোনার পরে তার মামী উত্তেজিত হয়ে উঠে তার সমস্ত কিছু উজাড় করে কুরবান এবং তাসদ্দক দিতে চাইলেন, বললেন, ‘আপনি কি ধরণের নিদান চাইছেন? আমি আপনাকে সুস্থ করে তুলতে আমার জীবন কুরবান দেব’। তখন শাহজাদা তাকে সব কিছু বললেন খুলে। শুনে তার তো জিভ আটকে গেল, কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। তখন আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আপনি খালিই আমার স্বাস্থ্য-কল্যাণ করতে গিয়ে বেকার অনেক কথা বলেছেন। আপনি যদি আমার নিদানের কোন বার্তা না দিতে পারেন, তাহলে আপনি কি করে আমায় সুস্থ করবেন ভাবছেন!’ উত্তরে মামী বললেন, ‘আমি কি আপনার বলি হব? আপনি অমানুষ সইফ খাঁকে জানেন। তার মত রক্ত খেকো মানুষ বিশ্বে বিরল। তিনি আপনি কেন সম্রাট শাহজাহানকেও পাত্তা দেন না। আপনার অনুরোধ শুনে তিনি প্রথমে হিরা বাঈকে কাটবেন, তাঁরপরে আমাকে হত্যা করবেন। তাকে আপনার প্রেমের কথা বলা মানে আমার জীবন কুরবান করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু কোন দোষ ছাড়া কেন তার জীবন যায়?’ শাহজাদা বললেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন। আমাকে অন্য কোন পথ নিতে হবে’।
সন্ধ্যার পরে শাহজাদা তার ঘরে ফিরে এলেন। কিচ্ছু খেলেন না। তার অধীন দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান মুরশিদ কুলি খাঁকে ডেকে তিনি পুরো ঘটনাটা বিশদে আলোচনা করলেন যদি কোন সূত্র মেলে। মুরশিদ উত্তর দিলেন, ‘প্রথমে আমি সইফকে ঠিকানা লাগাই(হত্যা করি)। এবং তার পরে যদি কেউ আমায়, আমার সন্ত, আমার পথ প্রদর্শকের কাজ সিদ্ধ করার জন্য হত্যা করে, তাতে আমার কোন হতাশা হবে না, কেননা আমার রক্তের দামে আপনার ইচ্ছে পূরণ করা গেল’। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি জানি তুমি নিজেকে কুরবানি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার হৃদয় চাইছেনা আমার মামিকে বিধবা করতে। আর কোরানিয় আইনে হত্যা করা পাপ। তুমি সর্বশক্তিমানের নাম নিয়ে সইফ খাঁএর সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা কর।’ মুখের একটা রেখা না বদলে, সেই মূহুর্তে মুরশিদ কুলি বেরিয়ে পড়লেন সইফের সঙ্গে কথা বলতে। সইফ উত্তর দিলেন, ‘শাহজাদাকে আমার সালাম জানাবে। আমি তাঁর মামিকে এই উত্তরটা দেব’। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জেনানা মহলে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘এটায়ক্ষতি কোথায়? আমার আওরঙ্গজেবের বেগম, শাহ নওয়াজ খাঁয়ের কন্যার প্রতি বিন্দুমাত্র লোভ নেই। তাকে বল গিয়ে তাঁর হারেম থেকে তাঁর উপপত্নী ছত্তর বাঈকে (হীরা বাঈয়ের সঙ্গে) বদল করতে’। সইফ আওরঙ্গজেবের মামিকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে তাঁর কাছে যেতে বলল; তাঁর স্ত্রী নিমরাজি হতেই সইফ হুমকি দিল, ‘নিজের জীবন যদি চাও তাহলে চিঠি নিয়ে যাও’। তাঁর যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না, শাহজাদার সামনে গিয়ে সব বলতে বাধ্য হল। খুশি হয়ে উত্তেজিত স্বরে শাহজাদা বললেন, ‘আমার হারেম থেকে একজন দিতে কি ক্ষতি? তাকে এক্ষুনি পালকি বাহনে পৌঁছে দিন, এবং আপনারা দুজনে চলে আসুন, আমার কোন আপত্তি নেই’। একজন খোজাকে দিয়ে সেই বার্তা পাঠালেন তাঁর স্বামীর কাছে। সইফ উত্তর দিলেন, ‘আর কোন ঘোমটা থাকল না’, এবং কোন বিলম্ব ছাড়াই বাঈকে শাহজাদার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
মন্তব্য – এই বর্ণনায় বহু ভ্রান্তি রয়েছে। সইফ খাঁ, মমতাজ মহলের বড় দিদি মালিকা বানুকে বিয়ে করেছিলেন(সালিহা বানু নয়)। শাহজাহানের সিংহাসনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই খন্দেশ থেকে তাঁর কর্মচ্যুতির নির্দেশ হয়, আর তিনি সরকারি কাজ ফিরে পান নি। ১৬৪১এর ২৫ আগস্ট মালিকা মারা যান। ১৬৪০এ তাঁর পতি সইফ খাঁ মির্জা সফি বাংলায় প্রাণ হারান(সূত্র পাদশা)।
মনে হয় মাসিরউলউমারায় যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা কিছুটা কাছাকাছি যায়-
শাহজাহানের ২৩তম(পাণ্ডুলিপি পাঠে ৩০ এবং ৩ দুটোই ভুল সংখ্যা আছে) বছরে(১৬৪৯-৫০) আসফ খাঁএর জামাই, মীর খলিলকে(উপাধি ছিল মুফতাখর খাঁ, সিপাহদার খাঁ এবং খানইজামান) দাক্ষিণাত্যে কামান বাহিনীর প্রধান করে পাঠানো হয়। ১৬৫৩ সালে তিনি ধারুরএর মনসবদার হন। একমাত্র আওরঙ্গজেবের সময় তিনি খণ্ডেশের সুবাদার হন(জুলাই ১৬৮১, মৃত্যু ১৬৮৪)। তাঁর সিংহাসনে বসার আগে থেকেই আওরঙ্গজেব জিয়ানাবাদীকে ভালবাসতেন। তিনি খাঁএর হারেমে ছিলেন। একদিন শাহজাদা তাঁর হারেমের সঙ্গীদের নিয়ে জৈনাবাদ বুরহানপুরের হরিণ বাগানে ঘুরতে গিয়েছেন। শাহজাদার মামী(খানইজামানের স্ত্রী)কে গান শেখাতে আসা জৈনাবাদী শিক্ষিতা গায়িকা এবং চাটুকারিতাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি শাহজাদাকে সামনে দেখেও পাত্তা না দিয়েই ফলাবনত আম গাছ থেকে আম পাড়তে শুরু করেন। এই ঘটনা শাহজাদার হৃদয় চুরি করে নিল। আওরঙ্গজেব তাঁর সমস্ত ধর্মীয় শিক্ষা, সন্তভাব ঝেড়ে ফেলে, নিজের ওপর সব রকমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লজ্জাহীনভাবে ছলেকৌশলে তাকে মামীর প্রাসাদ থেকে হাসিল করলেন। গল্প বলা হল একদিন সব ধর্মতাত্ত্বিকতা বিসর্জন দিয়ে, তার ধর্মীয় প্রকৃতিকে প্রায় অসম্মান জানিয়ে জৈনাবাদী শাহজাদাকে একপাত্র সুরা পান করতে অনুরোধ করেন। হৃদয়হারা শাহজাদা তা পান করতে উদ্যত হলে, সেই ধূর্ত যাদুকরী তাঁর হাত থেকে পাত্রটা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য ছিল, আপনার প্রেম পরীক্ষা, কোনভাবেই এই অভাগা মদ পান করানো নয়’। এই প্রেম কাহিনী শাহজাহানের কানে পৌঁছল। আওরঙ্গজেব বিদ্বেষী দারা শুকো এই ঘটনায় সম্রাটের কানে বিষ ঢাললেন, ‘এই মিথ্যাবাদী ভণ্ড দুর্বৃত্তকে দেখুন! তাঁর মামীর বাড়ির পোষা কুত্তির দিকে তাঁর নজর গিয়েছে!’ কিছুদিনের মধ্যেই জৈনাবাদীর মৃত্যু হয়। আওরঙ্গজেব তাকে আওরঙ্গাবাদের এক বৃহৎ দীঘির পাড়ে সমাধি দেন। তাঁর মৃত্যুর এক দিন পর আওরঙ্গজেবের শরীর খারা হয়। তাঁর পার্শ্বচর মীর আসকারি(আকিল খাঁ) একান্তে তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘এই ধরণের হৃদয় বিদারক অবস্থায় কোন জ্ঞানের কথা বলা উচিত, যাতে হৃদয় শান্ত হয়’। তখন শাহজাদা কবিতায় উত্তর দিলেন,
‘ঘরে বসে হাহাকার, কোন হৃদয়কে শান্ত করে না,/ একান্ত একা থাকাই কান্নায় হৃদয়ের তপ্ত কটাহ শান্ত করে।
এর উত্তরে আকিল খাঁ বললেন,
কত তাড়াতাড়ি ভালবাসা উদয় হয়, কিন্তু কি সুকঠিন সে,/ কি সুকঠিন বিচ্ছেদ, কিন্তু প্রেমাস্পদকে কে শান্তি দেবে’।
শাহজাদা তাঁর চোখের জল আটকাতে পারলেন না, পদ্যটির লেখকের নাম জানতে চেয়ে সেটি তাঁর স্মৃতিতে রেখে দিলেন।
মানুচি এই গল্পটা এইভাবে বলেছেন,
‘তাঁর হারেমের নাচনেওয়ালির প্রতি আওরঙ্গজেব মন দিয়ে ফেলেন। প্রেমের জন্য তিনি তাঁর নামাজ, তাঁর পড়াশোনা, তাঁর নিয়মনিষ্ঠা সব হারাতে বসেছিলেন। তাঁর জীবন কাটছিল সঙ্গীত আর নাচের মহফিলের মধ্যে দিয়েই। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেকে মদ্যের ভিতর ডুবিয়ে ফেলেন। নাচনেওয়ালির মৃত্যুর পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জীবনে আর কোন দিন তিনি মদ ছোঁবেন না, গান শুনবেন না। পরের দিকে তাকে বলতে শোনা যেত, সর্বশক্তমান খোদা তাকে টেনে নিয়ে আওরঙ্গজেবকে উদ্ধার করেছেন’।
কিন্তু কবে এই ঘটনাটা ঘটল? আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হন দুবার – ১৬৩৬-১৬৪৪ আর ১৬৫৩-১৬৫৭। এই দ্বিতীয়বারের সুবাদারিতে মুরশিদ কুলি খাঁ খুরাসানি এবং মীর আসকারি তাঁর অধীনে কাজ করতেন। ১৬৫৩তে আওরঙ্গজেব ৩৫ বছর বয়সী এবং ছয় সন্তানের পিতা; মনে হয় না তখন যে রকম তাকে হৃদয়হারাভাবে উপস্থাপনা করা হচ্ছে, তিনি সেই বয়সে এতটা হৃদয় চাঞ্চল্য বোধ করবেন। আকবর নিয়ম করে যান, উপস্ত্রীদের নাম হারেমে আসার আগে তাদের শহরের নামে নাম হবে(সূত্র পাদসানামা)। সেই সূত্র ধতে আমরা মহিলাদের নাম পাচ্ছি আকবরাবাদী, ফতেপুরী, আওরঙ্গাবাদী, জয়নাবাদী এবং উদিপুরী। বুরহানপুরের তাপ্তি নদীর তীরের জৈনাবাদ। ইনায়াতুল্লার আহকমএ আমাদের নায়িকার কবরের কথা উল্লিখিত আছে, যদিও সেখানে তাঁর নাম ভুল ভাবে বলা হয়েছে জৈনপুরী।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment