আমরা কারিগরেরা গুরু বাক্য স্মরণ করে বলে থাকি উপনিবেশের বড় শক্তি হল, সে তাঁর পদ্ধতিতে শিক্ষিতজনকে তাঁর সমাজের কৌমস্মৃতিতে ফিরে যেতে কৃষ্টিগতভাবে বাধা দেয় এবং সে মনে করে উপনিবেশের কৃষ্টির তুলনায় তার সমাজের কৃষ্টি যথেষ্টই ন্যুন। প্রশ্নহীনভাবে সে উপনিবেশের দেখিয়ে দেওয়া জ্ঞানচর্চা অনুসরণ করে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোন একটি আবিষ্কারের যে পূর্বাপর থাকে সেই উদাহরনগুলো পশ্চিম সযত্নে এড়িয়ে যায়। কর্পোরেট আবিষ্কারের উদ্যম এমন একটা জ্ঞানচর্চার ধারা তৈরি করার চেষ্টা করে যাতে মনে হয়, আধুনিক, ঔপনিবেশিক বিজ্ঞানের কোন পূর্বসূরী নেই, আধুনিক ঔপনিবেশিক ইওরোপিয় বিজ্ঞান স্বয়ম্ভু, একমেবদ্বিতীয়ম, ইওরপিয় নবজাগরণের আগে সারা বিশ্ব অন্ধকারে বিরাজ করছিল। বিশ্বের কোন অঞ্চলের দীর্ঘ জ্ঞানচর্চার প্রবাহের প্রভাব তার ওপরে পড়ে নি।
এর আগে আমরা চিকিৎসা শাস্ত্রের ক্ষেত্রে দেখেছি, কিভাবে ইওরোপিয় সওদাগর কোম্পানিগুলি
মালাবার ওডিশা, বাংলার দেশিয় গাছগাছড়া এবং তার গুণাগুণ আর প্রয়োগের জ্ঞান নথি করণ করে, ইওরোপিয় চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান উন্নত করেছে। অথচ সেই প্রভাব তারা আজও অস্বীকার করে। একই ঘটনা ঘটেছে টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও। জেনারের টিকা আবিষ্কারের আগে বহুকাল ধরে এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় গুটি বসন্তের টিকা দেওয়া হত এবং সেই টিকা ইওরোপিয় এলাকায় নিয়ে গেলে সেখানে অন্তত একশ বছরের বেশি সময় ধরে তার সক্রিয় বিরোধিতা করা হয় এবং শেষমেশ গরীবদের নগদ কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে টিকা দেওয়ার উদ্যম হাতে নিতে হয়। এবং পরের দিকে এশিয় পদ্ধতিতে টিকাকরণের প্রভাব বাড়তে থাকলে, কর্পোরেট টিকাকরণকে চালাবার জন্যে এই টিকা করণ পদ্ধতিকে নিষিদ্ধ করণ করে। একইসঙ্গে চিনা-বাংলার টিকা দেওয়ার জ্ঞানের যে শিক্ষা তারা নিয়েছিল, নিজেরদের দেশের টিকা আবিষ্কার হওয়ার পরে সেই জ্ঞানচর্চার অভিজ্ঞতা তারা মুছে ফেলে। বাল্যে বিদ্যালয় পড়াশোনায় আমরা ইওরোপের মুক্তিদাতা হিসেবে জেনারের কথা অপরূপ সম্মান নিয়ে পড়েছি।
কিন্তু দুটো তথ্য সেই লেখাগুলোতে বলা হত না, প্রথমত এশিয় টিকা করার অভিজ্ঞতা দ্বিতীয়ত ইওরোপিয় পাগান(গাঁইয়া) নিদান। জেনারের একজন দুধওয়ালির থেকে জ্ঞান আহরণ, যে যার গো-বসন্ত হয় তার গুটি বসন্ত কখোনোই হয় না – এই তথ্যটার বিশ্লেষণের গুরুত্ব এড়িয়ে গিয়ে জেনারের আবিষ্কারকেই রোমান্টিকভাবে
ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হয়। জানানো হয় না এটা গ্রাম ইওরোপের নিজস্ব নিদান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাটি কি ছিল। জেনার শুধু সেটি নকল করে বড় পুঁজির জ্ঞনাকারে ঢেলে সাজিয়েছেন। টিকার আবিষ্কারে এশিয়া আর গ্রাম ইওরোপ, নব্য কর্পোরেটিয় ইওরোপের কাছে সেই সম্মানটা কখোনোই পায় নি।
এই জ্ঞানটি বিশ্বের দুটো প্রান্তের গ্রাম সভ্যতার, নব্য ইওরোপ সেটিকে আত্মীকরণ করে নিজের মত করে সাজিয়েগুজিয়ে নিয়েছে মাত্র। এইভাবে গ্রাম এশিয়া পাগান ইওরোপের জ্ঞান আত্মীকরণ করে সেগুলিকে ধ্বংস করেছে বা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে বা বেমালুম অস্বীকার করে চোখ উল্টে ফেলেছে।
পরের কিস্তিতে আমরা ভারতে মাচিত্র তৈরির প্রথম পর্যায়ে কিভাবে দেশিয় জ্ঞান চুরির ঘটনা ঘটেছিল সেই উদাহরণ দেখব।
No comments:
Post a Comment