অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞাও
তিনটি ভাষার ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ধারাটি গিলক্রিস্টের মতে প্রথমে হিন্দৌভি, তারপরে সংস্কৃত, সব শেষে হিন্দুস্থানী। সংস্কৃত স্বাভাবিক ভাষা নয়, সে হিন্দৌভির স্থান জোর করে দখল করে কপট বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণদের চক্রান্তে। যে যুক্তিতে গিলক্রিস্ট উপনীত হলেন সেটা হল, ঐতিহাসিকভাবে সংস্কৃত হিন্দৌভির পরে এসেছে; এর সঙ্গে তিনি ভাষার বিবর্তনের তত্ত্বকে মিলিয়ে দিলেন। তিনি বললেন যদি সংস্কৃত অন্য দুটির আগের ভাষা হবে, তাহলে সেটি কেন (ইওরোপিয় দৃষ্টিতে) অনাবশ্যক জটিল বুননের হবে এবং কেন তার নামের সঙ্গে কৃত্রিম বা পালিশ করা বোঝাবে? তিনি বুঝি উঠতে পারছেন না, কিভাবে এত জটিল ভাষা অতীতের সভ্যতায় গড়ে উঠল। এর উত্তরও তিনি দিয়েছেন, তার মতে ধূর্ত বৈয়াকরণিকেরা মানুষের মুখের ভাষাকে তুলে নিয়ে সেটিকে কৃত্রিমভাবে গড়ে তুলে বলছে এটা পুরনো ভাষা। মানুষের ভাষা থেকে তারা একটি জটিল রহস্যময়, কিন্তু পুজার জন্যে পুরোহিতদের হাতে তুলে দেওয়ার ভাষা তৈরি করে। পুরোহিতদের ভাষা একটি বিপুল চক্রান্তের অংশ যেখানে তারা সমাজে দুটি প্রভাব সৃষ্টি করল, প্রাথমিকভাবে হাল্কা নিপীড়নের এবং দ্বিতীয়ত অকথ্য সার্বজনীন ধর্মীয় আচার(ইনস্যাটিয়েবল ক্যাথলিক রেলিজিয়াস পারসুয়েশন) প্রচার। ভাষার সৃষ্টিকর্তা ব্রাহ্মণেরা তাদের জ্ঞানকে ব্যবহার করে ভারতের হিন্দু জনগণকে দাস করে রাখল। ব্রাহ্মণদের তিনি খলনায়ক পুরোহিত দাগিয়ে দিলেন এবং তাদের প্রণীত শিক্ষাকে বললেন উচ্চনাদী অসংলগ্ন এঁড়ে ব্রাহ্মণ নেকড়েদের আচরণ।
গিলক্রিস্ট বহু গণ্ডগোলের পরে তার শব্দার্থ প্রকাশ করেন। এর পরে লাগাতর ভারতীয় ভাষা বিষয়ে ভারতীয় এবং ব্রিটিশ উভয় বোদ্ধাদের চরম সমালোচনা শুরু করে দিলেন, বিশেষ করে তাদের উদ্দেশ্যে যারা মনে করেন হিন্দুস্থানী শেখার জন্যে যে কোন একটি ধ্রুপদী ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক। ১৭৯৯ সালে তিনি কলকাতায় কোম্পানির কর্মচারীদের ভাষা শিক্ষার জন্যে একটা ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্থাপনের পরিকল্পনা করলেন। সে সময় কোম্পানি করণিককে ৩০টাকা দিত একজন ফারসি ভাষা শেখার মুন্সি নিয়োগ করার জন্যে। গিলক্রিস্ট সেই ছিদ্র দিয়ে ঢুকে মুন্সির মাইনেটা খেয়ে নিজে বিদ্যালয় খুললেন। তার বক্তব্য মুন্সিদের দিয়ে ভাষা শিক্ষা অকার্যকর কারণ তারা ইংরেজি তো বলতেই পারে না আর তাছাড়া শিক্ষা দেওয়ার সরঞ্জামেরও বেশ অভাব রয়েছে। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্থাপন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভর্নর ওয়েলেসলি বিজ্ঞাপন দিয়ে বললেন, ১৮০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অফিস অব ট্রাস্ট এন্ড রেসপন্সিবিলিটিতে কোন আমলা নিযুক্ত হবে না, যদি সরকার মনে করে আইন আর প্রথা সম্বন্ধে তার যথেষ্ট জ্ঞান নেই ... এবং সেই দপ্তরগুলির কাজ করতে গেলে তার বেশ কয়েকটি ভাষায় দখল থাকা চাই।
১৮০০ সালে ওয়েলেসলির পরিকল্পনায় ফোর্ট উইলিয়ামে কলেজ স্থাপন হওয়ায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি উঠে গেল এবং নতুন কলেজে গিলক্রিস্ট হিন্দুস্থানী ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন। গিলক্রিস্টএর তত্ত্বাবধানে একদল ভারতীয় বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত হল যাদের কাজ হল হিন্দুস্থানী বিষয়ে বৌদ্ধিক, শিক্ষাতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিক গবেষনা করে বেশ কিছু প্রকাশনা করা যার বলে আগামী দিনে ছাত্ররা হিন্দুস্থানী বিষয়ে পড়তে, বলতে এবং লিখতে পারবে। কলেজে ইওরোপিয় শিক্ষকদের মধ্যে দুটি দল তৈরি হয়ে গেল, একদল চাইল ধ্রুপদী ভাষা হোক দেশিয় ভাষা শিক্ষার বাহন, কেউ চাইল কোন ভাষা শেখার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে ভাষাটি গড়গড়িয়ে বলার চেষ্টায়, তত্ত্ব প্রয়োগ। গিলক্রিস্ট আর উইলিয়াম কেরি ছিলেন দ্বিতীয় দলে। দুজনেই আলাদা আলাদা ‘ডায়ালগ’ লিখলেন যাতে নতুন ছাত্ররা কথ্যভাষার স্বাদ পেতে পারে, একই সঙ্গে নতুন কাজে যোগ দিতে যাওয়া করণিকেরা ভারতীয় প্রথা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করতে পারে।
No comments:
Post a Comment