জাদুঘরভিত্তিক
পদ্ধতি
বহু ইওরোপি মনে করত(আজও
করে) ভারত যেন জীবন্ত জাদুঘর – ভারতের গ্রামাঞ্চল যেন প্রত্নতাত্ত্বিক খণ্ডহরে ভর্তি,
জনগণ যেই প্রবাহিত অতীতের প্রতিচ্ছবি – পুরাণোক্ত, ধ্রুপদী এবং সামন্ততান্ত্রিক; ভারত
যেন ইওরোপিয় জাদুঘরগুলির ফাঁকা তাক পূর্ণ করার, চিড়িয়াখানার খাঁচা ভরার, বোটানিক
বাগানের শূন্য উদ্যানে রোপন করার আর গ্রামের জমিদারি প্রাসাদ সজ্জার অন্যতম প্রধান
সূত্র।
১৮৬০ পর্যন্ত ভারতের
প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞান – এর শিল্প, স্থাপত্য, লিপি, এবং লিখিত ঐতিহ্য সমুদ্র পারে
প্রবাহিত হওয়ার উদ্যম নিয়েছিলেন মূলত কিছু উৎসাহী জ্ঞানী ব্যক্তি এবং গবেষণা আর
জ্ঞান সংক্রান্ত সঙ্গঠনগুলি। এছাড়াও ততদিন পর্যন্ত এই উদ্যমটা ছিল অন্যান্য তদন্তমূলক
পদ্ধতির উপজাত কর্মমাত্র। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বহু শিল্পী ভারতে আঁকার কাজে
দায়িত্ব পেয়ে বা কর্মসূত্রে বা পৃষ্ঠপোষণাসূত্রে আসেন – যেমন ড্যানিলে ভায়েরা,
উইলিয়াম হজেস বা জর্জ চিনারি ইত্যাদি – তারা কেবল ভারতের প্রাকৃতিক দৃশ্য বা ধনী
নবাব বা আমলাদের ব্যক্তিচিত্র আঁকেন নি, তারা বিভিন্ন প্রাক্তন সাম্রাজ্যের নানান
কীর্তিচিহ্নের খণ্ডহরগুলির দৃশ্যও উপস্থাপন করেছেন সারা বিশ্বের সামনে। ভারতের
জনসমষ্টি, প্রাচ্যের নানান ছবি সম্বলিত বই, পোর্টফোলিও, ছাপা এবং আঁকার একটা বড়
বাজার তৈরি হয়েছিল ব্রিটেনে এটাও মনে রাখা দরকার।
রাজস্বব্যবস্থা এবং
সেটলমেন্ট পদ্ধতির উপজাতকর্ম হিসেবে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা চিহ্নিত এবং
মানচিত্রকরণ করা হল। ভারত সাম্রাজ্যে প্রথম বিশাল বড় প্রত্নতাত্ত্বিক উতখননের কাজ
করেন দাক্ষিণাত্যে কলিন ম্যাকেঞ্জি। তিনি সরকারি প্রশাসনিক আমলাগিরি ছাড়াও সেই
বিশাল প্রাচীন অঞ্চলে কুড়ি বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা, লেখ, পুথি, মৌখিক
ইতিহাস সংগ্রহ করেন।
ভারতে নীলচাষ করতে
আসা নীলকর জেমস ফারগুসন ১৮৩৭-১৮৪২ পর্যন্ত ভারত জুড়ে ঘুরে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক
ইতিহাস সংগ্রহ করেন এবং কর্তৃত্ববাদী ইতিহাস এবং ভারতীয় শিল্পকলা আর স্থাপত্যের
বিবর্তন বিষয়ে লেখার অন্যতম পথ প্রর্শক হিসেবে আজ চিহ্নিত হয়ে আছেন। ক্রিস্টাল
প্যালেস প্রদর্শনী আয়োজন করার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। সরকারিভাবে তিনি
ভারতীয় শিল্পকলার অন্যতম গুণগ্রাহী হিসেবেও তার নাম উঠে আসত এক সময়ে।
সেনাবাহিনীর
প্রযুক্তিবিদ আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠে
১৮৫৯ সালে ভারত শাসক ক্যানিংকে প্রভাবিত করে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া
স্থাপন করেন এবং তার প্রথম কর্তা নির্বাচিত হন। এই দপ্তরের প্রাথমিক কাজ ছিল,
ভূসংস্থানগত গবেষণার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খুঁজে বার করা। এছাড়াও
এই সঙ্গঠনটির অন্যতম কাজগুলির মধ্যে প্রধান ছিল বিভিন্ন ঐতিহাসিক ক্ষেত্রকে
সুরক্ষা দেওয়া এবং সেই স্থানেই জাদুঘর তৈরি করে প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপনা করা এবং
জাতীয়স্তরে যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা ইত্যাদি সংগ্রহ হচ্ছে সেগুলির একটি
কেন্দ্রিয় প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপনা করা। ভারতের প্রথম জাদুঘরটি স্থাপনা করা হয়
কলকাতায় এক্কেবারে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলে। এটি
ক্রমশ ভারতীয় জাদুঘরে রুপান্তরিত হল, যেখানে বিপুল সংখ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক,
ঐতিহাসিক এবং জাতিতাত্ত্বিক উপাদান এবং নমুনা প্রদর্শিত হয়েছে।
উনবিংশ শতকের
মাঝামাঝি সময় থেকেই নানান আন্তর্জাতিক মেলা, উৎসব বা বিশ্ব প্রদর্শনীতে সরকারি এবং
সরকারি স্তরে সংগৃহীত ভারতীয় শিল্পকলা, অঙ্কন এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান
বিপুলভাবে উপস্থিত হতে থাকে। ভারতের অতীতকে প্রশাসনিক এবং সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিতে
উপস্থাপন করে ভারতীয় ইতিহাসের চরিত্র নির্নায়ক সম্পর্কিত বিশ্বজনমত তৈরি করার এই
উদ্যম উপনিবেশিক প্রকল্পের একটা বড় অংশ ছিল।
No comments:
Post a Comment