অধ্যায়২
গিলক্রিস্ট আর হিন্দুস্তানির সংজ্ঞা
কেরির ‘ডায়ালগ’ শুরু হচ্ছে একজন খানসামা বা সরকারের সঙ্গে ইওরোপিয়র আলাপ দিয়ে।
যে ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন সেটি ফারসি, বাংলা আর ইংরেজির সংমিশ্রণ। দৈনন্দিনের
একটি গৃহস্থ বাড়ি চালাতে কি কি প্রয়োজন হয়, সেকথাই এই ‘ডায়ালগ’এ বলা হয়েছে। সাহেব
শিখবেন কিভাবে আগোছালো ব্যবহার আর কাপড়জামার জন্যে চাকরের ওপর চোপা করতে হয়,
ভ্রমনের সময় কি কি প্রয়োজন হয় গুছিয়ে দেওয়ার জন্যে, আর বাংলোতে কিভাবে বাগান করতে
হয়। এছাড়াও নানান ধরণের ভারতীয়র(বলা দরকার ছিল বাঙালি) সঙ্গে যেমন শহুরে ভাষায়
ব্রাহ্মণ বলে পুজোপার্বন আর পরিবার বিষয়ে, সেখানে সাহেব শেখে আত্মীয়তার
সম্পর্কগুলো আর ধর্মীয় আচার। নিম্নশ্রেণীর মানুষ যেমন জেলে, নিচুজাতের মহিলার
সঙ্গে আলাপ আছে; যে ভাষা কেরির মতে যে ভাষা আক্ষরিকভাবে সঙ্গতিহীন। কেরি
দায়িত্বপূর্ণ ও বিচক্ষণ বাঙ্গালিকে কাজে লাগিয়ে এই ‘ডায়ালগ’গুলি তৈরি করেন। শিশির
কুমার দাসের মতে কেরিকে সহায়তা দেন যতদূর সম্ভব রাম রাম বসু এবং মৃত্যুঞ্জয়
বিদ্যালঙ্কার।
গিলক্রিস্ট তার প্রথম হিন্দুস্থানী আলাপ প্রকাশ করেন ১৭৯৮ সালে ওরিয়েন্টাল
লিঙ্গুইস্টের পাতায়। এটি নতুন করে লেখা হয় ১৮০৯ এবং ১৮২০ সালে। ১৮০৯এর সংস্করণের
ডায়ালগে তিনি যুবা ব্রিটিশকে শেখান কি করে আম ভারতীয়র সঙ্গে কথা বলতে হয়। তার
প্রত্যেক ভারতীয় চরিত্রই চাকর। তিনি ইওরোপিয়কে শেখালেন কিভাবে দেশিয় মানুষকে
নির্দেশ দেওয়া যায়। এই নির্দেশের বয়ানটাই শুরু হচ্ছে শুনো শব্দ দিয়ে। গিলক্রিস্টএর
মতে এই শব্দটা চাকরকে সব সময় এক পায়ে খাড়া করে রাখবে। তাকে নির্দেশ দাও খুব সহজ
ভাষায়, তাকে বলো না আমাকে একটি পেয়ালা দে, শুধু বল পেয়ালা। ইওরোপিয়কে অনুজ্ঞানসূচক
বহুচন ব্যবহার করতে হবে আমরা অমুক অমুকটা চাই। তার নির্দেশ চাকরের সঙ্গে কোন খুচরো(ক্যাজুয়াল)
আলাপ কোরো না কারন, দুর্বৃত্ত হিন্দুস্থানীরা যে কোন আবাল(ইনোসেন্ট) প্রশ্নকেও
নিজের দিকে ঘুরিয়ে ইওরোপিয় কর্তাকে কোন না কোন ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে।
ডায়ালগে এই বিষয়গুলো আলোচনা আনে – খাওয়া এবং খাদ্য
তৈরি(৩১ পাতা), ব্যক্তিগত সেবা যেমন কাপড়জামা পরা বভা বিছানা তৈরি করা(১৮ পাতা), কাছে
আর দূরের ভ্রমন(৪৩ পাতা), খেলাধুলা আর বিনোদোন(২৭ পাতা), মেমসাহেবরা কি করে
চাকরদের সঙ্গে ব্যবহার করবে(মাত্র ৭ পাতা), পড়াশোনা (১৪পাতা) ব্যবসায়িক কাজকর্ম(১৩
পাতা), চাকরকে সামান্য বকাঝকা এবং খিস্তিখেউড়(এবিউজিং) করা এবং খবর বার করা(১৩
পাতা), সময় এবং জলবায়ু(৫ পাতা), নরমভাবে জিজ্ঞাসা (২পাতা), স্বাস্থ্য, ওষুধ, স্থানীয়
চিকিতসকের সঙ্গে আলাপালোচনা(৪০ পাতা – যতদূর সম্ভব এটি লিখতে গিয়ে গিলক্রিস্ট
নিজের পুরোনো পেশা মনে পড়ছিল)। কথাবলার সুরটাই হল বাগাড়ম্বরপূর্ণতা – আমাকে ওটা
এনে দে, সব সরিয়ে নিয়ে যা, সকালের খাবার তৈরি কর ইত্যাদি। গিলক্রিস্টের নিদান হোল
সাহেবকে খুব তাড়াতাড়ি চাকরের সঙ্গে কড়া ভাবে কথা বলা শিখে নিতে হবে, রোজ সকালে আমি
তোকে আমার খাবার টেবিলের সামনে দেখতে চাই নাহলে বুঝিয়ে দেব কত ধানে কত চাল অথবা,
আমি তোকে ছাড়িয়ে দেব, বেয়াদব, অথবা ভাল চাস তো শুধরে যা নইলে আমি তোকে জেলে পাঠাব
ইত্যাদি। খাওয়ার দেওয়ার ফেরিওয়ালাকে সব সময় তার খাদ্যর গুণাগুণ সম্বন্ধে কড়া কথা
শুনিয়ে দিতে হবে। এখানে একটা বাক্য পেলাম যেখানে গিলক্রিস্ট তাকে বলতে বলছেন
রুটিতে বালি আছে রে ব্যাটা। প্রত্যেকটা আলাপে চাকরদের ব্যর্থতা, ভুল কাজ আর মূঢ়তা
প্রকাশ পেয়েছে – চামচ ছাড়া স্যুপ দিয়েছিস কেন, খাওয়ারটা খুব বেশি গরম, ঠাণ্ডা,
মোটা বা খুব পাতলা। চাকরকে বলতে হবে আগামি দিনে এই হিন্দুস্থানী খাবারটায় এত মশলা
দিবি না, আমি শুধু কালোমরিচের স্বাদ চাই, বা মদটা ঠাণ্ডা নেই কেন?
No comments:
Post a Comment