অধ্যায়২
ভাষার আধিপত্য আর
আধিপত্যের ভাষা
ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দেশ(কাওয়াম) এবং শাসক এবং শাসিতের মধ্যে
যে সম্পর্ক, তা ইওরোপ এবং ভারতে ভিন্ন রূপী ছিল। সপ্তদশ শতকের ভারতে তারা মনে করত এদেশের
সব কিছু এবং প্রত্যেক মানুষকে দাম দিয়ে কেনা যায়। উপহার/উপঢৌকন/খেলাত ইত্যাদির
মাধ্যমে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, সেগুলিকে নির্দিষ্ট মূল্যে মাপ ও দাম ধার্য করা যায় বলেও
তারা মনে করত। যেমন তারা যে কাপড় কেনাবেচা করত, সেটি ব্যবহার্য্য বস্তু হিসেবেই
চিহ্নিত হত এবং ইওরোপিয় নীতি অনুযায়ী সেটির দাম বাজারেই নির্ধারিত হত। তারা বুঝতে
চেষ্টা করে নি, কিছু ধরণের কাপড়, গয়না, অস্ত্রশস্ত্র এবং পশুপাখির বাজার নির্ধারিত
দামে কেনা যায় না, বরং তার চরিত্র নির্ভর ক’রে, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা কোন ব্যক্তি
বা সামাজিক সম্পর্ক সেই বস্তুটির ওপর কিভাবে আক্ষরিকভাবে কৃষ্টিগত চরিত্র আরোপ
করছে এবং সেই ধারনাটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হচ্ছে।
হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েই বস্তু এবং ব্যক্তিত্বের
অনির্দিষ্ট মৌলিক তত্ত্বের ওপরে নির্ভরশীল। শাসকের দেহটাই তার শাসন, যেটি বিভিন্ন
রূপে শাসিতের দিকে প্রবাহিত/ধাবিত হয়, ইওরোপিয়রা এগুলিকে শুধুই জাগতিক বস্তু
হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কাপড়, শস্ত্র, গয়না বা কাগজের মাধ্যমে শাসক তার পছন্দের
প্রার্থীকে তার শাসন ক্ষমতার গুরুভারের একাংশ অর্পণ করে। ক্ষমতাধরের নজরে বা সামনে
থাকা, বা তার অন্ন গ্রহণ করা বা তার শব্দ শ্রুত হওয়াই সেই ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে।
ইংরেজি ভাষায় ব্রিটিশেরা কোন একটি শব্দের, শব্দবন্ধের অথবা
বস্তু অনুবাদ করতে গিয়ে, ‘স্বাভাবিক/প্রাকৃতিক(ন্যাচুর্যাল’) বিশ্বের কাছাকাছির
কোন বস্তুকে চিহ্নিত করে সেগুলির প্রতিশব্দ হিসেবে ভেবে নেয়। ভারতীয়দের কাছে
এইভাবে কোন শব্দের মানে তৈরি হয় না। যজ্ঞে উচ্চারিত সংস্কৃত শ্লোকের মানে আর
সেগুলি শোনার মানের পার্থক্য ইওরোপিয়দের কাছে ধরা দেবে না, শব্দব্রহ্মের এবং তার
সাহিত্যিক শক্তির প্রভাব তারা জানেও না, বোঝেও না। যখন কোন মুঘল শাসক নির্দিষ্ট
পরওয়ানা বা ফরমান জারি করেন, সেটা যেমন একটি নির্দেশের থেকে অনেক বেশি, এটি
প্রাপককের ক্ষমতায়নের(এন্টাইটলইমেন্ট) থেকেও অনেক বেশি। এটি নথির দেহে লিখিত
শব্দের অর্থের থেকে অনেক বেশি জোর বহন করে, যা ব্রিটিশদের চোখে অধিকার অথবা চুক্তিমাত্র।
ফলে একটি চুক্তি, চিঠি ইত্যাদি নথি হাতে পেয়ে তারা সেটির অবলীলাক্রমে শাব্দিক
অনুবাদ করিয়ে নিত এবং সেই অর্থগুলি বাস্তবিক অর্থেই প্রয়োগ করত। নথিটির কাগজের
চরিত্র, লিখন ভঙ্গিমা, অক্ষরের ছাঁদ, লব্জগুলির বিবরণাদি, ব্যকরণ, পাঞ্জার ছাপের
চরিত্র, লেখকের স্তর, প্রাপকের হাতে পৌঁছনোর মাধ্যম, বাহক – ইত্যাদির প্রত্যেকটার
নির্দিষ্ট মানে ছিল।
No comments:
Post a Comment