উপনিবেশউত্তর পর্বে তদন্ত পদ্ধতি
ঐতিহাসিক এবং নৃতত্ত্ববিদ উভয়েই সরাসরি ঔপনিবেশিক সময়ে ক্ষমতার হাতে তামুক খেয়েছেন – যদিও এই তকমায় নৃতত্ত্ববিদেরা খুব খুশি হবেন না বলাই বাহুল্য। একটি আলাদা জ্ঞানচর্চা হিসেবে নৃতত্ত্বর উদ্ভব কিন্তু ইওরোপিয়দের নিজেদের দেশের এবং বহির্দেশের উপনিবেশ সূত্রে। গোটা উপনিবেশিক সময় ধরেই কিছু নৃতত্ত্ববিদ এঁড়ে তর্ক করে গিয়েছেন যে তাদের বিশেষ একটি কাজ হল ঔপনিবেশি শাসক আর উপনিবেশের শাসিতের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করা। যখন থেকে নৃতত্ত্ব নিজেকে আলাদা জ্ঞানচর্চা হিসেবে উপস্থাপনের দাবি করেছে, সে দিন থেকেই ভারত উপনিবেশে সরকারিভাবে ঔপনিবেশিক জনতত্ত্বের তাত্ত্বিক অবস্থান তৈরির জন্যে পরিশ্রম করে গিয়েছে। নৃতাত্ত্বিকেরা বলেছেন তারা এমন একটা পদ্ধতি বার করার চেষ্টা করছেন, যেখানে না কি তারা ঔপনিবেশিক প্রভাব ছাড়াই মৌলিক দেশিয় কৃষ্টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন। ইওরোপিয় ঔপনিবেশিকরা দেশের উপনিবেশ এবং বৈদেশিক উপনিবেশের প্রজাদের জীবন প্রভাবিত করতে এই জ্ঞানচার্চিক বিশ্বটিকে বিশ্লেষণ করেছে সমাজ তত্ত্ব বিষয়ে ইওরোপিয় ধারনা এবং ক্ল্যাসিফ্যাক্টরি স্কেমা অবলম্বন করে।
বিংশ শতাব্দের শুরুর সময়ে পেশাগতভাবে নৃতত্ত্ববিদেরা পরম্পরার সমাজের সঙ্গে কাজের সময় কি দায়িত্ব পালনীয় হতে পারে, সেটি নিজেদের মধ্যের আলাপচারিতার সময় ক্ষমতা সেই সমাজগুলিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে সব শব্দবন্ধসূচক ভাষ্য তৈরি করেছিল যেমন নেটিভ বা আদিবাসী বা ওয়াল্ড ম্যান, তাঁরাও সেই হিসেবেই বলতে শুরু করলেন। রাজনৈতিক উপনিবেশ শেষ হলে নৃতাত্ত্বিকেরা তাদের ঔপনিবেশিক কর্মকে ইতিহাসে রূপান্তরিত করলেন, এবং তারা যে জ্ঞানচার্চিক পরিমণ্ডল তৈরি করেছেন, তাকেও তার্কিকভাবে বুঝতে এবং সমালোচনা করতে চাইলেন। নৃতাত্ত্বিকদের তদন্তের পদ্ধতিগত চরিত্রই হল জনতাত্ত্বিক ক্ষেত্রসমীক্ষা; ঔপনিবেশিক সময়ে জনতাত্ত্বিক ক্ষেত্রসমীক্ষায় যে প্রবন্ধ এবং ক্ষেত্রসমীক্ষাগুলি লেখা হল, এবং তাত্ত্বিক ক্ষেত্র বিস্তৃত হল, সেটি কিন্তু আদতে উপনিবেশের কৃষ্টি প্রকল্পই এটাও কিন্তু মনে রাখা দরকার।
সাম্রাজ্যের কোন উপনিবেশের রাষ্ট্রীয় শাসন শুধুই পশ্চিমি সমাজ বিজ্ঞানীদের তদন্তমূলক কাজকর্মকে প্রভাবিত করে নি। বিংশ শতাব্দের মধ্য এবং শেষ পাদে এসে বিশ্বক্ষমতাধর শক্তি হিসেবে ব্রিটেনকে প্রতিস্থাপিত করল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফলে অন্য(আদার – যেমন নেটিভ আমেরিকান বা জাপানি)দের বোঝার, তাদের সম্বন্ধে তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা চলল সে সময়ের প্রাতিষ্ঠানিক তাত্ত্বিকতার ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়েই। সমাজবিজ্ঞানীরা ডিপ্রেসনের সময় ভীষণভাবে সরকারি নানান প্রকল্পের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকলেন; যেমন অর্থনীতিবিদ এবং সমাজতাত্ত্বিকেরা নিউ ডিলের সামাজ উন্নয়নের নীতি নির্ধারণ এবং সেগুলি মাঠে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারিগর হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন।
১৯৩০এর দশকে নৃতাত্ত্বিকেরা নিজেদেরকে নেটিভ আমেরিকানদের নানান কাজে জড়িয়ে ফেলতে শুরু করলেন। এই কাজে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি হল, নেটিভ আমেরিকানদের রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণ এবং স্বশাসন দিতে যে ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান এফেয়ারের তৈরি হল, তার দৈনন্দিনের কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। নৃতাত্ত্বিকদের ডেকে বলা হল ইন্ডিয়ান মধ্যশ্রেণীর মার্ফত যে ইতিহাস এবং সমাজতত্ত্ব বিষয়ে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি নির্ভর করে ইন্ডিয়ানদের ইতিহাস এবং সমাজতত্ত্বচর্চা স্থাপন করা – যেটি নির্ভর করে আদিবাসী সমাজের যে ফেডারেশন তৈরি হচ্ছে তার ভিত্তি নির্ণয় হবে। ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের মাধ্যমে ইন্ডিয়ানদের সংরক্ষণ দিতে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা পর্ষদ তৈরি হল, সেখানেও বিপুল সংখ্যায় নৃতাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিকেরা কাজ পেলেন। সংরক্ষণকাজে কৃষি অর্থনীতিবিদদের যুক্ত করে ডিপ্রেশন থেকে বেরোনোর দাওয়াই এবং চরিত্র বিশ্লেষণে আমেরিকিয় অর্থনীতির তাত্ত্বিক সমান্তরাল চিন্তাভাবনার শুরুয়াত হয়। অভিজ্ঞতার সূত্রে ইন্ডিয়ানদের জন্যে যে নিউ ডিল তৈরি হল, তার কাজ হল তাদের প্রাতিষ্ঠনিক অর্থনীতি আর কৃষ্টিতে টেনে এনে ইওরোপিয়ত্বের দেহে আত্মীকরণ করানো।
No comments:
Post a Comment