পর্তুগিজদের ভারতে আসার সময় থেকেই ইওরোপিয়রা নানান ধরণের দেশিয় গাছ গাছড়া সংগ্রহ এবং নথিকরণ করার উদ্যম দ্যাখা দেয়। নথিকরণ ছাড়াও তারা গ্রীষ্মএলাকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ দেশে নিয়ে যাচ্ছিল তাঁর বড় কারণ,
১)প্রাথমিকভাবে ইওরোপের জলবায়ুতে এশিয় ধরণের বিপুল প্রজাতির গাছ হয় না,
২) বিশ্ব লুঠের কাজে বিপুল সংখ্যক মানুষ তখন সমুদ্র যাত্রা করছে, তাদের স্বাস্থ্য বিধান করা জরুরি। ফরাসীরা ভারতে/এশিয়ায় খুব বড় বাণিজ্য শক্তি ছিল না। ১৬৬৪ থেকে ১৭৮৯র মধ্যে ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১২০০০০ হাজার বিভিন্ন স্তরের নাবিক, ব্যবসায়ী এবং আমলা সমুদ্র যাত্রা করেছিল। তাদের মধ্যে একতৃতীয়াংশ সমুদ্রেই প্রাণ হারায়। সংখ্যা প্রায় ৩৫০০০ জন। ১৬৮৯ সালে বঙ্গোপসাগরে ডাক্তার শল্যচিকিতসক সহ গোটা ৬০০ জনের একটি ফরাসি নৌসেনা দল কয়েক দিনের মধ্যে অসুখেই মারা গিয়েছিল। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির মোট ব্যবসার মাত্র কয়েক শতাংশ ব্যবসা করা ফিরাসী কোম্পানির যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে পর্তুগিজ, ব্রিটিশ আর ডাচেদের অবস্থা অনুমেয়,
৩) ইওরোপের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তখনও প্রাচীন স্তরে পড়ে রয়েছে। তাকে উন্নত করতে বিকশিত উপমহাদেশিয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নকল করতে প্রাকৃতিক সম্পদ নিজেদের দেশে আনা দরকার,
৪) যে সব ইওরোপিয় কোম্পানি চিকিৎসক ভারতে কাজ করা কর্মচারীর চিকিৎসা করত তাদেরও সেই গাছগুলো জানা দরকার ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফলে ইওরোপিয় প্রত্যেক কর্পোরেট কোম্পানি উদ্যম নিল ভারতের এই বিপুল গাছগাছালির জ্ঞান নথিকরণ করার, এবং সেগুলি নিজেদের দেশে নিয়ে যাওয়া যাতে এই জ্ঞান তাদের স্বাস্থ্য এবং কোম্পানির ব্যবসায় কাজে লাগে।
নথিকরণের প্রথম উদ্যম পর্তুগিজ গার্সিয়া দা ওর্তা এবং ক্রিস্তোভাও দা কোস্টা(ক্রিস্তোভাল একোস্তা)র। এরা দুজনে বহু বছর মালাবার উপকূলে কাটিয়ে প্রথম অধার্মিক বই লেখেন, যার বিষয় গাছগাছড়ার নথিকরণ। ওর্তার প্রথম বই Coloquios dos simples e drogas . . . da India ১৫৬৩ সালে পর্তুগিজ উপনিবেশে প্রকাশিত হ্য়। এটাই কোন ইওরোপিয়র করা এশিয় গাছগাছালি জ্ঞান নথিকরণের প্রথম উদ্যম। ১৫৬৭তে এটি ল্যাটিনে অনুবাদ করেন ষোড়শ শতের ইওরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদবিদ এবং লিডেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা চার্লস দা লেক্লুজ (ক্যারোলাস ক্লুসিয়াস)।
ভারতীয় সমুদ্র এলাকায় নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি(Verenigde Oost-Indische Compagnie বা ভিওসি) সেদিনের বাটাভিয়া(আজকের জাকার্তা) ১৬১০ সালে একটি শল্যচিকিতসা কেন্দ্র এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করে আনা নানান প্রজাতির গাছের একটি বাগান তৈরি করে। ১৬৭০এ মালাবারের ডাচ কমাণ্ডার হেন্ড্রিক আড্রিয়ান ভ্যান রিডি ড্রাকেন্সটাইন, সেই অঞ্চলের গাছগাছালি নথিকরণ বিষয়ে বিপুল এক উদ্যোগ নেন আজ যেটি হর্তাস ইন্ডিকাস মালাবারিকাস নামে বিখ্যাত। এই বইতে ৭২০টি ঔষধি গাছের, কলম-কালিতে ছবি আঁকানো হয়েছে এবং প্রত্যেকটির বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এটি আমস্টার্ডামে ১৬৭৮ থেকে ১৬৯৩ পর্যন্ত পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়, কিছু তাঁর মৃত্যুর পরেও প্রকাশিত হয়। আরেক ডাচ পল হারম্যান শ্রীলঙ্কাতেও একই কাজ করেন। ভিওসি ডাক্তার জর্জ এবারহার্ড রামফ মলুকাস দ্বীপে একই প্রকার প্লিনাস ইন্ডিকাস রচনা করেন। এই বিপুল জ্ঞান অবলম্বন করে ডাচেরা বিভিন্ন উপনিবেশে যেমন উত্তমাশা অন্তরীপ, বাটাভিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় বিভিন্ন দেশের নানান ধরণের গাছগাছড়া, ফল, ফুল, জাহাজ বানানোর এবং সারানোর কাঠ, বাণিজ্যিক ফসল ইত্যাদির বিপুল ব্যবসা শুরু করে দেয়।
ব্রিটিশেরাও পিছিয়ে ছিল না। পলাশীর বহু আগে থেকেই তারা ব্যক্তিগত উদ্যমে যতটা পারা যায় উদ্ভিজ্জ জ্ঞান আর নানান রকমফেরে প্রজাতিগুলির নমুনার অংশ ব্রিটেনে নিয়ে যেতে থাকে। মধ্যসপ্তদশ শতে ডাচ এবং ব্রিটিশ কোম্পানি গোটা ইওরোপ জুড়ে, এশিয় পণ্য আর মশলা বাণিজ্যের সঙ্গে খুঁজে নেয় বিপুল এশিয় প্রজাতির নানান ধরণের গাছ, বিশেষ করে ওষুধ তৈরির কাজে লাগে এমন গাছের অসম্ভব লাভের বাজার।
এইভাবেই একে একে ইওরোপে চলে গিয়েছে বাংলা তথা ভারতীয় তথা এশিয় জ্ঞান। ইওরোপ তাতে লাভবান হয়েছে। কিন্তু ইওরোপের চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাসে সেগুলি কোনদিনই উল্লিখিত হয় নি।
No comments:
Post a Comment