শিল্পবিপ্লব শুরুর আগে ইওরোপের ত্রাস ছিল গুটি বসন্ত। অন্যান্য সংক্রামক রোগ, চাষী আর কারিগর উছেদ করা শিল্পবিপ্লবের কারখানার জন্যে তৈরি বস্তিতে শ্রমিকেরে জীবন নেয়, কিন্তু গুটি বসন্ত ধনী-গরীব মানে না। ১টাকা রোজের শ্রমিকের যেমন মুখে খাবলা বসায় তেমনি দৈনিক ১কোটি টাকা রোজগার করা মালিকের চোখ কেড়ে নেয়, অভিজাতদের ‘কুৎসিত’ বানায়, রাজপরিবারকে উজাড় করে দেয়। অন্যান্য শ্রমপ্রতিস্থাপনকারী, লাভ ও লুঠ বাড়াবার, মানুষ-নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র বানাবার উদ্যমে রোজগারের লভ্যাংশ সিন্দুকে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যদি অভিজাতদের জীবনে শান্তিই না আসে, মরে যেতে হয়, কুৎসিত হতে হয় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো হাজারো গরীবের মত, তাহলে এই লুঠের সম্পদ অভিজাতরা ভোগইবা করবে কি করে আর ভোগ করেই বা কি করবে।যদি না সে চেহারায়, মনে ধনে সাধারণের থেকে আলাদা হতে পারল। ফলে প্রকৃটি যা দিয়েছে তাকে ধ্বংস করো, বিশ্বকে বড় পুঁজির উপযোগী করে বানাও।
গাঁইয়া, শহুরে সাধারণ মানুষ প্রকৃতিকে তার জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে হাজার হাজার বছর চলেছে। এশিয়া আমেরিকা আর আফ্রিকার ধনীদের একাংশও তাই। এশিয়ার চিন, পারস্য, আরব, তুর্কি, কিছুটা আফ্রিকা গুটি বসন্তের মত হাজারো রোগ সঙ্গে নিয়ে চলেছে। তাদের সাধারণ জীবন দিয়ে বোঝা তত্ত্ব হল দেহে গুটি বসন্ত একবার আঘাত হানার পর আর আক্রমণ করে না। তারা যেটা করতেন সেটা হল গুটি বসন্তের পাঁচড়া(গুটির চামড়া) নিয়ে বসন্ত না হওয়া মানুষের দেহে ঢুকিয়ে দেওয়া। ব্রিটিশরা যাকে ভাইরোলেশন বলল।
কিন্তু বেকনিয় প্রকৃতিকে দাস বানাবার তত্ত্বে উৎসাহিত অভিজাতরা এই রোগ নিয়ে বাঁচতে উত্যসাহী নয়। তাদের প্রাথমিক উদ্যম হল বিশ্বের মানচিত্র থেকে গুটি বসন্তকে চিরতরে মুছে ফেলা। ইওরোপের অভিজাতরা আর প্রকৃতিকে তাঁর জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে দিতে রাজি নয়। তো খোঁজ চলল কিভাবে এটাকে নিশ্চিহ্ন করা যায়, সে পদ্ধতির।
ইওরোপে প্রথম গুটি বসন্ত রোখার খবর পৌঁছল চিন থেকে। ৫ জানুয়ারি, ব্যবসায়ী জোসেফ লিস্টার, ডক্টর মার্টিন লিস্টারকে চিঠ লিখে চিন থেকে জানালেন বসন্তের পাঁচড়ার চামড়া গুঁড়ো করে নস্যির মত করে নাক দিয়ে নিচ্ছে চিনারা। ঐ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি হাড়ের ডাক্তার ক্লপ্টন হ্যাভার্স রয়্যাল সোসাইটিকে চিনের এই প্রথার কথা জানালেন। তুর্কিতেও এই ধরণের প্রথার কথা জানা গেল। বোঝা গেল এটি কন্সটান্টিনোপোলে ১৬৭৯এর পরে শুরু হয়েছে। ১৭১২ সালে ডাক্তার এডওয়ার্ড ট্যারি আলেপ্পো থেকে ফিরে জানালেন পেরা এবং গালাতা অঞ্চলে ৪০০০ মানুষকে এই ধরণের টিকা করণ করানো হয়েছে। রয়্যাল সোসাইটির সম্পাদক রিচার্ড ওয়ালার, ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে ব্রিটিশদের চিঠি লিখে বিষয়টি অনুসন্ধান করতে আর্জি জানান।
রয়্যাল সোসাইটির বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তুর্কির ভ্যারিওলেশন নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন তৈরি করেন গ্রিসে জন্মানো পাদুয়া আর অক্সফোর্ডে পড়া এবং রয়্যাল সোসাইটির ফেলো ডাক্তার এমানুয়েল টিমোনি ১৭০৩ সালে। তিনি কন্সট্যান্টনোপোলে ডাক্তারি করতেন। মনে করা হয় ১৭১৩ সালে তিনি সুইস রাজা দ্বাদশ চার্লসএর জন্যে স্বাক্ষরিত না করা প্রবন্ধ ল্যাটিনে লিখে স্টকহোমে পাঠান। পরে সেই লেখাটি নিজের নামে নুরেম্বার্গ, লিপিজিগ এবং ফরাসি রিজেন্ট কাউন্সিলে পাঠান। এটি ইংরেজিতে অনুদিত হয় এবং রয়্যাল সোসাইটির ফিলোজফিক্যাল ট্রাংজাকশনের ১৭১৪ এপ্রিল-জুন সংখ্যায় প্রকাশ পায়। খোঁজ চলতেই থাকে। কিন্তু বিষয়টা লন্ডনের অভিজাত বৈজ্ঞানিক-প্রাযুক্তিক-পেশাদারি মহলে খুব বেশি সাড়া ফেলে নি।
অটোমান সাম্রাজ্যের রাজদূতের স্ত্রী লেডি মন্তেগু ১৭১৬-১৭১৯ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে অটোমান রাজভায় ছিলেন। সে সময় মন্তেগু পরিবারের চিকিৎসক ছিলেন টিমোনি। ১৮ মার্চ ১৭১৮য় তাঁর পাঁচ বছরের পুত্রকে পেরা অঞ্চলে ভ্যারিওলেশন করান, বহু বছরের অভিজ্ঞ এক গ্রিক মহিলাকে দিয়ে। মহিলা বাচ্চাটির হাতে একটি ভোঁতা আর জংপড়া সূঁচ দিয়ে ক্ষত(incision) করেন। এতে সন্তুষ্ট না হয়ে বাচ্চাটির অন্য হাতে দূতাবাসের শল্য চিকিৎসক চার্লস মেইটল্যান্ড সূঁচ দিয়ে টিকা দেন। পরম্পরার ওপরে আধুনিকতার বিজয় সূচিত হল। এই ঘটনায় বিরক্ত হয়ে দূতাবাসেরে চ্যাপলেইন জানালেন এই প্রথা অখ্রিষ্টিয় এবং একমাত্র বিধর্মীদের দেহেই এটা প্রযুক্ত হতে পারে।
RAJESH KOCHHAR এর Smallpox in the modern scientific and colonial contexts 1721–1840
এবং
আশিস নন্দী সম্পাদিত SCIENCE, HEGEMONY & VIOLENCE A REQUIEM FOR MODERNITY থেকে
No comments:
Post a Comment