Friday, September 1, 2017

বাংলার জমিদারি৫ জাফরখানি বন্দোবস্ত

{বাংলায় মুর্শিদকুলি খাঁ - মুতামিন-উল-মুলক আলা-উদ-দৌলা জাফর খান নাসিরী নাসির জঙ্গ বাহাদুর' উপাধি পেয়ে সাত হাজারি মনসব পান এবং ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থাপন করেন। বাংলাকে তিনি ১৩টি চাকলায় ভাগ করে সেগুলিকে ২৫টি জমিদারি ও ১৩টি জায়গিরে বন্দোবস্ত করেন। এই বন্দোবস্তের নাম জমা কামেল তুমারী, এবং সমগ্র ব্যবস্থাটি জাফর খানি জমিদারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। এই আলোচনায় পরিষ্কার হবে বাংলার জমিদারেরা বংশপরম্পরায় জমিদারি ভোগ করছিলেন। মোটামুটি আগামী দিনে, পলাশীর পরে এবং ব্রিটিশ আমলেও বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থা জাফর খানি কাঠামো ধরে তৈরি হয়েছে।
এবারে পঞ্চম অংশ}
সায়ারাৎ মহাল(শুল্ক প্রভৃতি)
১) চুনাখালি - ১১৩০ সালে মুর্শিদাবাদ ও উপকণ্ঠ নগরগুলির(কাশিমবাজার ইত্যাদি) আমদানি রপ্তানি দ্রব্যের মাশুল ও হাটবাজার প্রভৃতির কর(ভূমি রাজস্ব বাদে) ৩১১৬০৩ টাকা।
২) বখসবন্দর বা হুগলি (৩৭টা গঞ্জ ও বাজারের রাজস্ব ও নানা প্রকার মাশুল কর প্রভৃতি) মোট ৩৪২৭০৮ টাকা। এর থেকে কলকাতার ৪৪৭৬৭ টাকা বাদ দিয়ে ২৯৭৯৪১ টাকা
৩) দার উল জারব মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকসালের আয়৩০৪১০৩ টাকা।
মোট সায়ের রাজস্ব ৯১৩৬৪৭ টাকা।
বাংলা ১১৩৫ সালের সমগ্র খালসা ও সায়ের জমা - ২৫ জমিদারি বিভাগে মোট ১২৫৬ পরগণায় ১০৯১৮০৮৪ টাকা।
জায়গির জমা
সে সময় বাংলার নানা স্থানে ভূমি নির্দেশ করে তার আয় থেকে নাজিম, দেওয়ান ও সৈন্যবিভাগের ব্যয় তোলা হত
১) সরকার আলি - সুবাদারের নিজস্ব ব্যয়ের জন্য জায়গির, চাকলা ঢাকা আর হিজলির মধ্যে এর অর্ধাংশ, অবশিষ্ট ভাগ যশোহর, রাজশাহী, কৃষ্ণনগর ও দিনাজপুরের মধ্যে ছড়ানো ছিল। বাদসাহ সেরেস্তায় এই জায়গিরের উৎপন্ন (রেকমি জমা) ১৬০৫৬৯৩ টাকা লেখা থাকলেও বর্তমান বন্দোবস্তে অন্যান্য জমিদারির মত আয় ধরে এই বিস্তীর্ণ ভূভাগের নির্দিষ্ট জমা - ৬০ পরগণায় ১০৭০৪৬৫ টাকা।
২) বন্দেওয়ালা দরগা বাদশাহী দেওয়ানের জায়গির। বাহিরবন্দ ও ভিতরবন্দ পরগণা। বাদশাহী সেরেস্তায় জমা ২৯২৫০০ টকা। কিন্তু মোট ২০ পরগণায় ১৪৬২৫০ টাকা মাত্র ছিল।
৩) জায়গির আমির উল উমরা বক্সী(প্রধান সেনাপতি) - মুর্শিদকুলিখানের সময় প্রধান সেনাপতি সামসামউদ্দৌল্লা খানদৌরান। বাংলার প্রতিনিধি মার্ফত তার আয় হত। বাদশাহী সেরেস্তায় জমা ৩৩৭৫০০ টাকা। এই জায়গির অসম ঢাকা শ্রীহট্টের দিকে নির্দিষ্ট হয়েছিল।সেনাপতির প্রতিনিধিরা জায়গিরের কাজ, ভাগ রক্ষা এবং আয় করবে এটাই উদ্দেশ্য ছিল - ১৮ পরগণায় ২২৫০০০ টাকা।
৪) জায়গির ফৌজদারান
ক) ঢাকার নায়েব নাজিমের(প্রতিনিধি শাসন কর্তার) জায়গির। রেকমী জমা ২৪০৭৫০ টাকা। ১১ পরগণা ১০০১৪৫ টাকা।
খ) শ্রীহট্ট জেলার ফৌজদার(সামসের খাঁ) ও অন্য চার জন সীমান্ত-রক্ষকের জায়গির - রেকমি জমা ৪৩০০০০ টাকা। ৪৮ পরগণা ১৭৯১৬৬ টাকা।
গ) পূর্নিয়ার ফৌজদার(সইফ খাঁ) ৯ পরগণা ১৮০১৬৬ টাকা
ঘ) ঘোড়াঘাট ফৌজদারি (মনসুর খাঁ) ৩ পরগণা ১৬৬৬৬ টাকা
ঙ) রাজমহল ও তেলিয়াগড়ির ফৌজদার (সুজার সময়ে আলিবর্দি খাঁ) ৪ পরগণা ১৬৬৬৬ টাকা।
মোট ফৌজদারি ৭৫ পরগণা ৮৯২৮০০ টাকা।
৫) মনসবদরান(সেনাদের জন্য)। মনসবদরান পাঁচশ সেনার নায়ক হয়েও হাজারী নামে খ্যাত ছ্যিল। তাদের সেনাদলের বেতন শ্রীহট্ট, ঢাকা, হিজলি ও রাজমহল সীমান্তে ছিল। ২০ পরগণা ১১০৮৫২ টাকা।
৬) জমিদারান - ত্রিপুরা মাকোয়া, সুসঙ্গ তেলিয়াগড়ি - এই চার জন সীমান্তের জমিদারের জায়গির ২ পরগণা ৩৯৭৫০ টাকা।
৭) মদৎ মাশ(ধর্মের জন্য দেয় জায়গির) বর্ধমান রাজমহলের বিভিন্ন এলাকায় আর হুগলির পেঁড়োর মসজিদ তৈরির জন্য ৭ পরগণা ২৫৬৬৫ টাকা।
8) শালিয়ানাদারান(বাৎসরিক বৃত্তি) শ্রীহটতের কয়েকজন তালুকদারের জন্য ৯ পরগণা ২৫৯২৭ টাকা।
৯) ইনাম আলতগমা(উত্তরাধিকার ক্রমে ভোগের জন্য) ২ জন মৌলবিকে দেয় ১ পরগণা ২১২৭ টাকা।
১০) রুজিআনদারান, জনৈক মোল্লাকে প্রদত্ত লস্করপুরের অন্তর্গত সামান্য তালুক ৩৩৭ টাকা।
মোট ৩৯ পরগণা ২১৪৭১৮ টাকা।
১১) আমলে নাওয়ারা - নৌসৈন্য বিভাগ আর তার জায়গির
উপকূলে বা নদীমুখে মগ ফিরিঙ্গি প্রভৃতি জলদস্যুর উপদ্রব নিবারণের জন্য প্রথমে স্থাপিত হয়। এই সময়ে ৯২৩ জন ফিরিঙ্গি বা পর্তুগিজ নাবিক এই বিভাগে নিযুক্ত ছিল। ৭৬৮টি সুসজ্জিত সশস্ত্র তরণী থাকত, মাসিক ব্যয় ছিল ২৯২৮২ টাকা। এটা আর নতুন নৌকো তৈরির খরচ হিসেবে ৮৪৩৪৫২ টাকা নির্দিষ্ট ছিল। ঢাকা ও শ্রীহট্ট চাকলায় জায়গির ভূমির ব্যবস্থা ছিল। ঢাকার মধ্যেই ছিল মোটের ৪/৫ অংশ। এই টাকার মধ্যে সীমান্তের জমিদারদের থেকে পেশকাশ রূপে ৫০ হাজারের কিছু বেশি টাকা আদায় হত। এটা আগের বন্দবস্তের বাইরে ছিল। ৫৫ পরগণা ৭৭৮৯৫৪ টাকা।
১২) আমলে অসম - পূর্বপ্রান্তের বিশেষ করে অসমের সীমান্ত, নদীতীর ও উপকূলভাগের বন্দর ইত্যাদি শত্রুর থেকে রক্ষার জন্য সেনানিবাস, সৈনিক ও প্রহরী প্রভৃতির ব্যয় নির্বাহের জন্য 'আমলে অসম' মানে এই জায়গিরের প্রতিষ্ঠা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় স্থাপিত ২৮২০ জন সেনার জন্য ১৩ পরগণায় ১৩৫০৬০ টাকা, ইস্লামাবাদ বা চট্টগ্রামের ৩৫২২ জনের জন্য ১১৭ কিসমতে ১৫০২৫১ টাকা, রাঙ্গামাটি বা কামরূপ অঞ্চলের ১৪৭৮ জন সেনার জন্য ৪ পরগণায় ৬৩৪৪৫ টাকা ও শ্রীহট্টের ২৮২ জন সেনার জন্য ৪ পরগণায় ১০৮২৪ টাকা রাজস্ব রাজস্ব নির্ধারিত ছিল।মোট ৮১১২ জন সৈনিকের জন্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ১৩৮টি পরগণার নির্দিষ্ট রাজস্ব ৩৫৯১৮০ টাকা।
১৩) খোদা আ ফিল - হাতি ধরার জন্য - হাতি ধরা হত ত্রিপুরা শ্রীহট্ট জঙ্গল থেকে। হাতি ধরার খরচের জন্য ত্রিপুরা ও শ্রীহট্টে খোদা আ ফিল জায়গির নির্দিষ্ট ছিল। তারজন্য রাজস্ব ছিল ৪০১০১ টাকা।
মোট বাংলার রাজস্ব-
খালসা ও সায়ারাৎ ১২৫৬ পরগণা ১০৯১৮০৮৪ টাকা
জায়গির ২১২ পরগণা ২১৩৯২৪২ টাকা
সৈন্য বিভাগ ১৯২ পরগণা ১১৭৮২৩৫ টাকা
সুজার সংশোধিত হিসেব ১৬৬০ পরগণায় ১৪২৪৫৫৬১ টাকা
বাদ নাজাই ৪২৬২৫ টাকা
মুর্শিদকুলি খাঁর জমা কামেল তুমারী ১৪২৮৮১৪৬ টাকা।
(ক্রমশঃ)
সূত্রঃ বাংলার ইতিহাস(আষ্টাদশ শতাব্দী) - নবাবী আমল - কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments: