{বাংলায় মুর্শিদকুলি খাঁ - মুতামিন-উল-মুলক আলা-উদ-দৌলা জাফর খান নাসিরী নাসির জঙ্গ বাহাদুর' উপাধি পেয়ে সাত হাজারি মনসব পান এবং ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থাপন করেন। বাংলাকে তিনি ১৩টি চাকলায় ভাগ করে সেগুলিকে ২৫টি জমিদারি ও ১৩টি জায়গিরে বন্দোবস্ত করেন। এই বন্দোবস্তের নাম জমা কামেল তুমারী, এবং সমগ্র ব্যবস্থাটি জাফর খানি জমিদারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। এই আলোচনায় পরিষ্কার হবে বাংলার জমিদারেরা বংশপরম্পরায় জমিদারি ভোগ করছিলেন। মোটামুটি আগামী দিনে, পলাশীর পরে এবং ব্রিটিশ আমলেও বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থা জাফর খানি কাঠামো ধরে তৈরি হয়েছে।
এবারে ষষ্ঠ অংশ}
আবওয়াব
মুর্শিদকুলি খাঁ সুজার বন্দোবস্তের ওপরে নিজের উদ্ভাবনী প্রশাসনিক মোহর অঙ্কিত করেন। তিনি জমিদারি বন্দোবস্তের ওপর অতিরিক্ত কর বসালেন যার নাম আবওয়াব খাসনবিশি। খাস অর্থাৎ নিজের সরকারের খালসা সেরেস্তার প্রধান কর্মচারী ও মুতসুদ্দিদের পার্বনীর খরচ যোগানোর জন্য এটির উদ্ভব। রাজস্বের ওপর পড়তা করে সামান্য এক নজরানাও ধরে নেওয়া হত। এটা এবং বাদশাহী নজরানা মিলে মোট খাসনবিশি হল ১৮৫৮৫৮৭ টাকা।
১। নজরানা মোকররি - সুজা খাঁ নবাবি ব্যয়ের জন্য রাজস্বের ওপর চার ধরণের আবওয়াব চাপিয়ে ১৯১৪০৯৫ টাকা আয় করেন। সুজার প্রথম কর নজরানা মোকররি বা স্থায়ী নজরানা। সমগ্র খালসা জমার ওপর সাড়ে ছয় টাকা অনুপাতে হয়ে এর পরিমান দাঁড়ায় ৬৪৮০৪০ টাকা।
২। জার মাথট হল দ্বিতীয় আবওয়াব মাথটের অর্থ হল হারাহারি বা অনুপাত অনুসারে দেয় আলগা খাজনা। চারটি বিষয়ের জন্য কর চাপানো হয় -
ক) নজর পুণ্যাহ - প্রতিবছর নবাব দরবারে বছরের প্রথম দিনে পুণ্যাহের দিন নিজের জমিদারির স্থির থাকল এটা জানার জন্য কর।
খ) বয় খেলাৎ - পুণ্যাহের দিন জমিদারদের যে খেলাৎ বা উপহার দেওয়া হত তার মূল্যস্বরূপ এই কর।
গ। পোস্তাবন্দী - নবাবি কেল্লার সম্মুখে ও লালবাগে ভাগীরথীতীরে পোস্তা বাঁধার(দেওয়াল বাঁধার) ব্যয়
ঘ। রসুম নেজারৎ - মফঃস্বল থেকে রাজস্ব আনার জন্য নাজির পদাতিক প্রভৃতির খরচের জন্য।
মোট চার দফায় ১৫২৭৮৬ টাকা।
মাথট ফিলখানা - সরকারি ফিলখানা বা হাতিশালার ব্যয় - কানুনগো রুকনপুর, জালালপুর, ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, পূর্ণিয়া রাজমহল, বীরভূম, বিষ্ণুপুর, পঞ্চকোট ইত্যাদি জমিদারি ছড়া পড়তা করে অন্যন্য জমিদার থেকে এই মাথট আদায় হত - মোট ৩২২৬৩১ টাকা।
৪। আবওয়াব ফৌজদারি - সুজা খাঁর সঙ্গে তার ফৌজদারেরা এলাকায় এলাকায় কর বৃদ্ধি করেন - তবে কর এলাকা অনুযায়ী নানান পরিমানে হয়।
১) পূর্নিয়ার আবওয়াব - পূর্ণিয়া ১৮৩০২৭ টাকা, শ্রীহট্ট ১৫৯৫৩৫ টাকা, ত্রিপুরা - ১৮৪৭৫১ টাকা, নিখাস বা মুর্শিদাবাদে পশু বিক্রির জন্য ১১৬৭৯ টাকা, থানাজাৎ - বাংলার যে সব এলাকায় সেনা বা প্রহরী নিবাস ছিল সেগুলোকে থানা বলত - সেগুলির ব্যয়ের জন্য বাজার থেকে কর আদায় করা হত। সুজার সময় থেকে এগুলি সরকারি নিয়মে রূপান্তরিত হয়। কাটোয়া থেকে ৪৮০০০, রাঙ্গামাটি থেকে হাতি ধরার খরচ ২৪০০০ টাকা, ভূষোয়ান্র নলদি থেকে ২৪০২৫ টাকা মাহামুদশাহী থেকে ১০৮৬০ টাকা এবং অন্যনায় ছোটখাট থানা থেকে ৮৮৪৩ টাকা মোট ১১৫৭২৮ টাকা আদায় হত। এই ফৌজদারির মট মোট আয় ১৫৪৭২০ টাকা।
২) ঘোড়াঘাটের আবওয়াব ১৯২৭৯ টাকা।
৩) মুর্শিদাবাদের ফৌজদারি আবওয়াব - ১৬৬৩৯ টাকা।
মোট ফৌজদার আবওয়াব ৭৯০৬৩৮ টাকা।
এতে দেখা যাবে মুর্শিদ কুলিখাঁ আর সুজার বাড়া আওবাব মিলিয়ে ২১৭২৯৫২ টাকা কর বৃদ্ধি ঘটে। আলিবর্দির সময়ে চৌথ মারাঠা, নজরানা মনসুরগঞ্জ প্রভৃতিতে ২২২৪৫৫৪ টাকা কর বৃদ্ধি পায়।
এরপর মীর কাসেমের রাজস্ব বৃদ্ধি
১) কেফায়াৎ হস্তবুদ(জমাবেশী)
ক) বীরভূমের জমিদার আসদ জামান খাঁকে উৎখাত করে নানা রূপে কর বৃদ্ধি ঘটে ৮২৬২৭৫ টাকা।
খ) দিনাজপুরের জমিদারি থেকে অন্যান্য আবওয়াব ছাড়া রাজকরের ওপর যে বৃদ্ধি হয় তা হল ৫৭৬৩২৪
মোট কেয়াফৎ হস্তবুদ ১৪৭২৫৯৯ টাকা।
২) কেয়াফৎ ফৌজদারান(ফৌজদারি রাজকর)
ক) পূর্ণিয়া - ১৭৫২তে মুর্শিদকুলিখাঁর প্রতিষ্ঠিত জায়গিরদার সইফ খাঁয়ের এন্তেকালের পরে আলিবর্দিখানের ভাইপো খাদেম হোসেনকে ফৌজদারি আয় দেওয়া হয়। মীরকাসেম এতার রাজস্ব খালসা সেরেস্তায় আনলেন। মজমা হল - ১৪২৩৭২৫ টাকা।
খ) ঢাকা জালালপুর - আলিবর্দীর সময়ে ঢাকার একাংশ নোয়াজিস মহম্মদের ব্যয়ের জন্য দেওয়া হয়েছিল। মীরজাফরের সমর এর একাংশ রাজবল্লভের হাত দিয়ে ননানের কাছে পোঁছত। রাজবল্লভ পাটনার নবাবি প্রাপ্তির আসায় ঢাকা বিভাগের পুরো আয় দেখিয়ে দিলেন। ঢাকার সরকারি ব্যয় করেও যা পড়ে থাকে তার পরিমাণ হল ১২০১৩১৫ টাকা।
গ) রঙ্গপুর কোচবিহার জঙ্গলমহল সীমান্ত প্রদেশর ফৌজদারেরা সামান্য কর দিতেন। এই সমস্ত আয় খালসা দপ্তরে জমা পড়ে দাঁড়াল ১৫১৪৯৮ টাকা।
ঘ) রাজমহল বা কাঁকজোল ফৌজদারি অধীনে যে খালসা ও ফৌজদারি ছিল তার ওপর বর্ধিত কর ৪২৭৫৭টাকা।
ঙ) চট্টগ্রাম আর বর্ধমান কোম্পানি চিরদিনের জন্য দেওয়া হয় নি এটা মীরকাশেম ধরে নিয়ে ছিলেন। অন্যান্য জায়গিরদারকে দেওয়া ভূমির মত, কোম্পানির সৈন্য সাহায্য প্রয়োজন না হলে সুবিধা মত তা পুনরুদ্ধার হবে এই আসা ছিল। এই তিনটে বিভাগ সরকারি কাগজে ও কানুনগো দপ্তরে ফৌজদারি বিভাগে পরিণত হয়েছিল। আদায় না হলেও এতে বৃদ্ধির পরিমান কাগজে দেখানো হল ২৯৬০০০ টাকা।
মোট ফৌজদারি আয় বৃদ্ধি ৩২১৫২৯৫ টাকা
৪) সায়ারাৎ(শুল্ক) বিভাগে বর্ধিত জমা
ক) চুনাখালি(মুর্শিদাবাদের প্রধান শুল্ক দপ্তর) ২৩১৭৯৩ টাকা।
খ) নবাবগঞ্জ (মহানন্দার আর গঙ্গার সঙ্গমস্থলে আদায়স্থান) ১১৮৭৯৩ টাকা।
গ) আসদ নগর(মুর্শিদাবাদের শুল্কবৃদ্ধি জমা) ৭০৭৮৭ টাকা।
ঘ) ভাণ্ডারদহ(মুর্শিদাবাদের উত্তরপূর্ব থেকে ভাগীরথীর একটা শাখা বের হয়ে জলঙ্গীর সঙ্গে মিশত। এর তীরে আদায়স্থান) ২৭৬০১ টাকা।
ঙ) আজিমগঞ্জ (দুমকল) কলকলীর তীরে ৬৪০১ টাকা
চ) চক চাঁদনী(মুর্শিদাবাদের বাজার) ৩৫৬০ টাকা
মোট সায়ারাৎ ৪৫৮৯৪৪ টাকা।
(ক্রমশঃ)
সূত্রঃ বাংলার ইতিহাস(আষ্টাদশ শতাব্দী) - নবাবী আমল - কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment