গঙ্গা ও পদ্মার দুপারেই দারুণ কৃষিকাজ হত। পদ্মার ধারের পাবনায় প্রচুর পান সুপারি ফলত। জেলার সোনাপাড়া, বাণদোর্ষী ও গোপালপুর অঞ্চলে প্রচুর সুপুরি চাষ হত। আত্রায়ী নদী তীরে বিপুল পরিমান ধান ও তুলা জন্মাত। তুলাচাষের জন্য কালো মাটি ছিল ঢাকা, রাজশাহী ও উত্তরবঙ্গের নানান অঞ্চলে। টেলর বলছেন এখানে ভাল জাতের তুলো জন্মাত। বাংলাদেশের ঢাকার তুলো গুণগতভাবে সেরা। ঢাকা জাফরগঞ্জের মাঝের এলাকাগুলোতেও তুলোর চাষ ছিল, যা স্থানীয় প্রয়োজন মেটাত। সমগ্র ঢাকা বিখ্যাত ছিল ধান আর তুলোর জন্য। পান চাষও হত। বীরভূমেও তুলো চাষ হত, পানও হত। সিউড়ির আশেপাশে ছিল ধান চাষ। বাঁকুরা আর বর্ধমানে যে তুলো চাষ হত তাতে স্থানীয় মানুষদের প্রয়োজন মিটত। রিয়াজ... জানাচ্ছে মালদায় নীলের চাষ হত। ফারমিঙ্গারের ‘ফিফথ রিপোর্ট’ থেকে বর্ধমানের বিশদ চাষের বর্ণনা পাওয়া যায় – মুগ, কলাই, ছোলা, মটর, তুলো, রেশম আর আখের মত রবিশস্য চাষের। রাজশাহী জেলায় বাংলার মোট রেশম উৎপাদনের পাঁচভাগের একভাগ পাওয়া যেত। কাশিমবাজারের বিপরীত পারে(গঙ্গার পূর্ব তীরে) লস্করপুরে কাঁচা রেশমের কুঠী ছিল।
গঙ্গারামের মহারাষ্ট্রপুরাণ ও ভারতভন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এ সময়ের খাদ্য শস্য আর রবি শস্যের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। অন্নদামঙ্গলে ‘দিল্লীতে উৎপাত’ তিনি বলছেন, ‘ধান চাল মাষ মুগ অরহর।/ মসুরাদি বরবটী বাটুলা মটর।।/ দে ধান মাড়ায়া কোদা চিনা ভুরা খর। জনার প্রভৃতি গম আদি আর সব।।’ গঙ্গারামও ‘চাউল কলাই মটর মষুরি খেসারির’ কথা জানিয়েছেন।
রামেশ্বরের শিবায়ন কাব্যে চাষের যন্ত্রপাতির বর্ণনা আছে এবং মাঠের চাষ, শস্য লালন পালন ও ঝাড়ায়ের নানান বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে।। রামেশ্বর চাষার যন্ত্রের নাম বলছেন চাষাস্ত্র। আজকের চাষের যন্ত্রপাতির সঙ্গে এর কোনই পার্থক্য দেখি না। সে সময় কোদালী, কাস্তে, লাঙ্গল, জোয়াল, ফাল, আগাছা দূর করার জন্য বিড়ে(নিড়ানি) এবং জমি সমান করার জন্য মই ব্যবহার করা হত(উল্লেখ্য তারও আধ সহস্রাব্দেরও বেশি আগে লেখা কৃষিপরাশরেও বাংলার চাষের কথা বলা আছে এবং মাড্ডিকার উল্লেখ আছে)। সারের কাজ করত গোবর।
বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ, কৃত্রিক জলসেচ নয়, বাংলার নদী-নালা, খাল বিল জলসেচের কাজ করত। বর্ষাকালে জমি বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখার ব্যবস্থা ছিল। জয়া মিত্র এই লেখককে পুরুলিয়ার পাহাড়ি এলাকায় টিলার ধাপ কেটে কেটে, পুকুরের উপচোনো জল নিচের পুকুরে জমা হওয়ার জন্য পুকুরের একধারে একটা ছোট্ট নালা কেটে প্রায় দশটার বেশি পুকুরের শৃঙ্খল তৈরির বিশদ বর্ণনা দিয়ে ছিলেন যা তামিলনাড়ুর দশপলা ব্যবস্থার এক্কেবারে অনুরূপ, কিন্তু বাংলার এই ব্যবস্থা নিয়ে কোন কাজই হয় নি প্রায়।
শুখা অঞ্চলে বর্ষাকালে জমিতে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখার ব্যবস্থা ছিল – বীরভূমের মল্লরাজারা বড় বড় বাঁধ দিয়ে বর্ষার জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। যে বিশাল বিশাল দীর্ঘিকা তৈরি হত, তারই নাম হয়ে যেত বাঁধ, লালবাঁধ, পোকাবাঁধ, সাহেববাঁধ ইত্যাদি। এই বড় বড় হ্রদ সম পুকুর আর বাঁধগুলি সীমান্ত জেলার পরিখার কাজ করত – দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচাত, খাবার আর চাষের জল সরবরাহ করত। মনে রাখা দরকার মুঘল আমল পর্যন্ত বাংলার সীমান্ত এলাকার প্রদেশগুলিতে রাজস্ব নেওয়া হত না। এছাড়া গ্রামবাংলার বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকার জন্য ছিল নানান ধরণের প্রযুক্তির আর স্থাপত্যের তৈরি অগণ্য পুকুর, যা আসলে মাটির জল খাবার পাত্র হিসেবে ব্যবহার হত, গৃহস্থের দৈনন্দিনের কাজে সাহায্য করত আর শীতকালে শস্যের চাষে সাহায্য করত।
No comments:
Post a Comment