[বিজ্ঞান, সাগরপারের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছিল দুই ভাবে। প্রথমত বিজ্ঞানের(আদতে প্রযুক্তি) মাধ্যমে দেশজুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রণ সফল হয়। দ্বিতীয়ত আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষমতাময় বৌদ্ধিক বিকাশ ইওরোপকে দিল জাতিবাদী এবং কৃষ্টিগতভাবে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা – যা পরে উপনিবেশের স্থায়িত্বের পক্ষে জোরদার বৈধতা দান করে। ১৮৬৯এর পরে ধরে নেওয়া যাক ১৯১৪ পর্যন্ত ভারতীয় উচ্চশ্রেণী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সচেতনভাবে মৌলিক বিজ্ঞান চর্চা করেছেন। ফলে সম্পদের বিকাশে বিজ্ঞানের অবদান আজ পর্যন্ত খুব বেশি চর্চিত হয় নি। স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান নীতি ঔপনিবেশিক বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতার গর্ভ থেকে জন্মানো। ফলে বৈদেশিক উদ্দেশ্য পূরণে ভারত প্রায়োগিক বিজ্ঞানেই আস্থা পেশ করল। ভারতীয়দের চেষ্টায় ঔপনিবেশিক সময়ে বিজ্ঞানের ব্রাহ্মণীকরণ ঘটল এবং ক্ষত্রিয়করণ ঘটল স্বাধীনতার পর। বিজ্ঞানের যে কারিগরিকরণ ইওরোপকে শক্তি জুগিয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতাটা ভারতে জন্মালই না।]
সব জ্ঞান ব্যবস্থাই কর্তৃত্বের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। আধুনিক বিজ্ঞান সবার থেকে আলাদা একটা বিষয়েই যে এই জ্ঞান প্রকৃতির ওপর খবরদারি করে এবং কৃষ্টিগতভাবে জাতিগতভাবে নানান মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের কাজে আভ্যন্তরীণভাবে জড়িয়ে থাকে। ১৫ শতকের প্রথম থেকেই ইওরোপের পক্ষে স্পেন এবং পর্তুগাল আফ্রিকার উপকূল ধরে ইসলামি এলাকা এড়িয়ে মশলাসমৃদ্ধ ভারতের দিকে রওনা হল, তাদের সে অর্থে কোন বৈজ্ঞানিক পরম্পরা ছিল না। তাদের সমুদ্র যাত্রার জ্ঞান এসেছিল ইহুদিদের সীমাবদ্ধ তাত্ত্বিকতায় বিকশিত পঞ্জিকা আর মুসলমানেদের সমুদ্র যাত্রার জ্ঞানে।
এই সমুদ্রযাত্রাগুলি থেকে চোখ কপালে তুলে দেওয়া লাভে আগামী দিনে ইওরোপিয় অর্থনীতির আমূল বদল ঘটবে। স্বচ্ছলতা আর সর্বশক্তিমান বা রাজার ইচ্ছের ওপরে নির্ভরশীল নয়, তা নির্ভর করল সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে দেশে জীবিতভাবে ফিরে আসার মাধ্যমে। ইওরোপিয় সামুদ্রিক যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরাধরি করে জন্ম নিল এবং বাড় বৃদ্ধি হল কর্পোরেট শিল্প এবং বিজ্ঞানেরে মাধ্যমে আর উপনিবেশ তৈরির ঘটনায় আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠনিকীকরণ বাড়বৃদ্ধি ঘটল, গুণগ্রাহী বাড়ল আর বৌদ্ধিকভাবে বিজ্ঞানের দেখনদারির ঘটনা ঘটে থাকল।
সমুদ্রযাত্রার প্রথম সময়ে দ্রাঘিমাংশ এবং স্কারভি নাবিকদের ওপর বিপুল প্রভাব ফেলত তখন প্রকৃতিকে দেখা হত শত্রু হিসেবে, যাকে পদানত করতে হয়। নতুনভাবে আবিষ্কৃত ভূমি থেকে দেশিয়দের ধরে এনে মেট্রোপলিটনে বিজয়স্মারকরূপে প্রদর্শন এবং তাদের পণ্য হিসেবে ব্যহারের যুগ শুরু হল। এই সময়ের চাহিদা ভদ্রলোক অভিজাত ফ্রান্সিস বেকনের(১৫৬১-১৬২১) লেখার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে এবং তিনি তাঁর সময়ে রাজনীতিক বা বিচারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের দার্শনিক হিসেবে প্রখ্যাত। বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক হিসেবে তার যুক্তি হল প্রকৃতি to serve the business and conveniences of man। তিনি বললেন, I am come in very truth leading to you Nature with all her children to bind her to your service and make her your slave। তার লেখার চিত্রকল্পগুলি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি আর তার সন্তানদেরকে দাস হিসেবে বানাবার চিন্তা করে তিনি আদতে আধুনিক বিজ্ঞানকে প্রকৃতি আর মানুষ দমন করার তত্ত্বে নির্ভর হতে বলেন।
আধুনিক বিজ্ঞান ইওরোপকে সারাবিশ্ব আয়ত্তাধীন এবং উপনিবেশের তাঁবে আনার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে এবং উপনিবেশ তৈরি করার উপযোগিতার তাত্ত্বিক অবস্থা বিকাশ করে – যে সমাজ ইওরোপিয় ক্ষমতাদম্ভী আধুনিক বিজ্ঞান জাতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা বিকাশ ঘটাতে পারবে, সেই সারা বিশ্বের ওপর সাম্রাজ্য বিস্তার করবে।
রাজেশ কোছারের Science and domination: India before and after independence প্রবন্ধ থেকে
No comments:
Post a Comment