হায় ভদ্রবিত্ত
১৮০০ সালে কলকাতায় ছিল ৩০% অবাঙ্গালি। আজ যে কলকাতায় আমরা বাস করি সেটা আদতে ঔপনিবেশিক শহর, অভিবাসীদের শহর।
গত দুশ বছর ধরে এই ৩০% আপনাকে সেবা দিল(কলকাতার বাড়ি আর রাস্তার পয়প্রণালীর কাজ করেন অবাঙ্গালি, ওডিয়া, ফুচকা দুধ বেচেন বিহারী, ঝাড়খণ্ডী, ট্যাক্সি চালক ভোজপুরী), ফুটপাথে বসে বাজার তৈরি করল(অধিকাংশ ওডিয়া, বিহারী, ঝাড়খণ্ডী), আপনার অর্থনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান পেশ করল, তাদের ঘাড়ে বসে কলকাতা মেট্রো সিটি হল, দত্ত, দে, লাহা, সাহা উপাধিধারী কিছু ব্যবসায়ী বাঙ্গাল মুসলমান ছাড়া ফুটপাথে কেন, ব্যবসা করা ব্যাপারটাকেই আপনি ঘেন্না করতেন। আপনি জেনে বসে আছেন নবজাগরণের অগ্রদূত মাইকেল ফ্যারাডে বলে গ্যাছেন ব্যবসা মানুষের চিত্ত কলুষিত করে। আজ ভদ্রবিত্ত আপনি, আপনার উত্তরপুরুষ দয়ে পড়ায় সেবা দেওয়া আর বাজার তৈরি করা অভিবাসী মানুষগুলোকে অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে।
আপনার সমস্যা হল তাঁরা এতদিন কলকাতায় থেকেও তাঁদের কৃষ্টি ধরে রেখেছেন। আপনি পারেন নি, কারণ আপনি আপনার সংস্কৃতিকে(যার মুল গ্রাম্যপন্থ, আপনার ভাষায় ধর্ম) উন্নাসিকভাবে দেখে এসেছেন। ফুটপাথে শীতলা, কালি, শিবের মন্দির হলে তাকে নিকৃষ্টভাবে দেখেছেন, তার বিরুদ্ধে কাগজে কলম লিখেছেন, পাঁচ রাত ধরে পাশের বস্তিতে শীতলা বনবিবি সত্যপীরের গান হলে পুলিশ ডেকেছেন মাইক থামানোর জন্যে। ভূমির সঙ্গে জুড়ে থাকেন নি। আপনার আরাধ্য ইওরোপ। সে আপনাকে যে দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছে আপনি সে দিকেই গ্যাছেন। আপনি আপনার কৃষ্টিকে কৃষ্টিই মনে করেন নি, তাকে লোকসংস্কৃতি দেগে দূরে সরিয়ে হয়ত দ্যাখন শ্রদ্ধা করেছেন, কিন্তু তাকে কাছে টেনে নেন নি। বিবিসি কেঁদুলিকে উডস্টক বলা মাত্রই আপনি কলার তুলে ছুটেছেন বাঘ পালানো শীতে গাঁজা চুষতে আর বান্ধবীকে নিয়ে বেলেল্লাপনা করতে। কেঁদুলিকে কেঁদুলি হিসেবে দেখেন নি, আপনি তাতে ইওরোপের ওম পোয়াচ্ছিলেন, ইওরোপে না যেতে পাড়ার স্বপ্নপূরণ করছিলেন।
আপনি মাইনে বাড়াবার জন্যে কলকাতাকে এ ওয়ান সিটি বানিয়েছেন, তারপরে মূল কলকাতা থেকে যখন ছোটলোকেরা হটে গ্যাছে, বা তাদের অনেকে যখন মধ্যবিত্ত থেকে ভদ্রবিত্ত রূপান্তরের পথে হাঁটছে, তখন অবাঙ্গালি অভিবাসীরা তার কৃষ্টি নিয়ে ফাঁকা ফুটপাথে নেমে এসেছেন। আপনার গায়ে লাগছে।
যতদিন তারা চুপ ছিলেন ততদিন তাদের খোল্কর্তাল বাজিয়ে চৈতা বা ফাগুয়া গাওয়াকে ব্যঙ্গ করেছেন চুটিয়ে।
হঠাত কলকাতায় জেগে উঠে আপনার মনে হচ্ছে নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেলাম না তো!
No comments:
Post a Comment