Monday, July 23, 2018

গ্রাম শিল্প পরম্পরা - সেরপাই - দেশিয় মাপন পদ্ধতি

সেরপাইয়ের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বাংলার মাপনচর্চা। 
তার গৌরব গিয়েছে। সেরপাই শুধু এখন মধ্যবিত্তের ঘর সাজানোর এক পণ্যমাত্র।
--
বাংলার গণ-মাপন
বাংলার জ্ঞানভাণ্ডারে যে সব মাপন একক রয়েছে, সের থেকে পাই, তাঁর দুটি শব্দাংশ। অঙ্ক কষা, সভ্যতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। ঔপনিবেশিক পশ্চিম যে মানুষদের অশিক্ষিত, অজ্ঞ, মুর্খ ইত্যাদি নামে ভূষিত করে আদিবাসী, অন্ত্যজ ইত্যাদি বর্গে বর্গীকৃত করেছে- লৌকিক বা পাগান বলে তথাকথিত মূলস্রোত(কাকে বলে?) থেকে বিতড়িত করে তাঁদের জাদুঘরীয়তায় রূপান্তরিত করার আগ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছে, সভ্যতার উষা কাল থেকেই তারাই কিন্তু অঙ্কের, গণনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন - সে সাধারণ মাটি বা পাথরের বাড়ির স্থাপত্যের কাজই হোক, সমুদ্রে নৌকো চালাবার কাজই হোক বা চাষের কাজে আবহাওয়া মাপনের কাজই হোক, বা তাঁত চালাবার কাজই হোক। এই মাপনের দক্ষতা বা তাঁদের বিষয়ে জ্ঞানচর্চার কাজগুলি নিয়ে বিশদে খুব আলোচনা না হলেও, কয়েকটা যে ছুটকো ছাটকা আলোচনা হয় নি এ কথা বলা যাবে না।
কিন্তু বাস্তবে যে আলোচনাটা প্রায় বিন্দুমাত্রই হয়নি, অন্তত এই পোড়া বাংলায়, তা হল মেয়েদের অন্তপুরের মাপন পদ্ধতি এবং তা্র বৈচিত্র্য। অন্তত বছর ছয়েক আগে লেখকের সঙ্গে একটি চলচ্চিত্র সাক্ষাৎকারে জয়া মিত্রদিদি বলেছিলেন, মেয়েরা সমাজের পুষ্টিধারক - কোন শস্য পুড়িয়ে খেতে হবে, কোনটিবা কাঁচা, কাকে আআবার সেদ্ধ করে, বা কাকে নানা পদ্ধতিতে গুঁড়ো করে সেবন করতে হবে সেই অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কাজটি মানব সভ্যতার উষাকাল থেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য ধন্যবাদহীনভাবে করেছিলেন বলেই আজ মানুষ মানুষ হয়েছে। এবং এই গুরুত্বপূর্ণতম গবেষণার কাজটি করতে গিয়ে কত মহিলা বিষ শস্য খেয়ে প্রাণ দিয়েছেন, কত মহিলা অসুস্থ হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। একই সঙ্গে তাঁদের সেই সব শস্যকে মাপন করতে হয়েছে। সেই মাপনের কাজে ব্যবহৃত পাত্র বিভিন্ন একালায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সেই পরিচয় দেওয়ার অবসর নেই।
মাপন অঙ্কের আরও গুরুত্বপূর্ণ সমাজের নাম সূত্রধর/ছুতোর আর রাজমিস্ত্রি। নাম থেকেই পরিষ্কার তারা সুতো ধরে মাপ করতে দক্ষ। সেই দক্ষতা তাদের উপাধিতে জুড়ে গিয়েছে। চন্দ্র কান্ত রাজু বলছেন কার্তেসিয় জ্যামিতিবাক্সের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু সুতো দিয়ে মাপের নেই। এই লেখাতার সূত্র দিলাম। পড়ে নিলেও ভুল হবে না http://ckraju.net/papers/MathEducation2RopeTrick.pdf
---
সেরপাই
সেই দেশিয় মুখে মুখে চলা মাপনগুলি আধুনিক কালে রূপান্তরিত হয়েছে সেরপাইতে। সের থেকে পাই পর্যন্ত এই হিসেব করার কাজটি করতেন মহিলারা।
স্বাধীনতা লড়াইয়ের সময় কংগ্রেসের ইংরেজিবিদ্য বাবু নেতারা দেশের শেকড় খুঁজতে বেরিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন সিউড়িতে এই সেরপাইয়ের। তাঁরা এর ইংরেজি নাম দিয়েছিলেন সিউড়ি বোল।
বীরভূমের সিউড়ির কাছের গ্রাম, লোকপুর খ্যাত সেরপাই-এর জন্য। এই গ্রামেরই ভোলানাথ কর্মকার শুধু বাংলাই নয়, ভারতের নানান স্থানে বেশ নাম কুড়িয়েছেন সেরপাই তৈরির জন্য। ভোলানাথ এই শিল্পটি শিখেছেন তাঁর শ্বশুর মশাই কার্তিক কর্মকারের থেকে। আর যেহেতু উতপাদকেদের পরিবারও সাধারণভাবে তাঁদের নানান কাজে হাত লাগান, সেরপাই তৈরিতে ভোলানাথের স্ত্রী রুমা আর কন্যা পুতুলও যথেষ্ট দক্ষ, কিন্তু তাঁরা ভোলানাথের সহকর্মীরূপেই বেশি কাজ করতে উতসাহী।
আগে আমকাঠ দিয়ে তৈরি হত সেরপাই, এখন হয় সেনাঝুরি দিয়ে। নির্দিষ্ট মাপ অনুযায়ী কেটে যে পাত্র বা খোনাটি তৈরি হয়, তার নাম ডোল। একে ঘসে মসৃণ করা হয়। ভুষো কালি, শিরিষ আঠা আর রজন দিয়ে কালো রং করা হয়। এর পর নকশা তৈরির পালা।
এর পর বাইরে তৈরি হয় পিতলের কারুকাজ, পিতলের পাত কেটে। পিতলের পাতের নকশার জন্য রয়েছে পুরোনো দিনের ফর্মা। নতুন সময়ে নতুন নতুন নকশারও প্রচলন হচ্ছে। তবে পুরোনোগুলো দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর। ফর্মা থেকে নকশা তুলে পাত কেটো ভ্রমর আর ফাইল দিয়ে সেই নকশা ফুটিয়ে তারপর এটি লাগানো হয় ডোল জুড়ে। এর পর পালিশ।
তৈরি হল সেরপাই।

No comments: