আমরা কারিগরেরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি, যে ভদ্রবিত্ত ৪০০ বছর আগে সে সময়ের আরেক ভদ্রবিত্ত চৈতন্যের ডাকে ক্ষমতা বিসর্জন দিয়ে রাস্তায় মিছিল করেছিল, বাংলার ভাব সমাজে আলোড়ন এনেছিল, সেই সমাজ গত আড়াইশ বছর হেঁটমুণ্ডঊর্ধ্বপদ হয়ে ভদ্রবিত্তিয় ঔপনিবেশিক দাস সমাজে রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান উত্তরপ্রজন্মকে বাধ্য করছে লুঠেরা ধ্বংস হতে বসা সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশের পদপ্রান্তে নমিত হতে।
জ্ঞানের সাথে ক্ষমতার যোগাযোগ প্রাচীন হলেও বাংলায় অন্তত ব্রিটিশ পূর্ব সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ কর্পোরেট স্বার্থ ক্ষমতাকে পেড়ে ফেলতে পারে নি, যার জন্যে রাজা/পাদশা/নবাবেরা কারিগরদের চাষীদের যথাযোগ্য পৃষ্ঠপোষণা করতেন। তারা দাদন ফিরিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু কর্পোরেটেরা তাদের ওপর অত্যাচার করতে পারত না। সে স্বাধীনতা তার ছিল পলাশীর আগে। এ ধরণের হাজারো উদাহরণ দিতে পারি। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জ্ঞানচর্চা ক্ষমতার কাছাকাছি না থেকেও সমাজ অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারত।
সেই প্রভাব দূর করতেই জোনস, কোলব্রুকদের আবির্ভাব এবং জোনসের হাত ধরেই ব্রাহ্মণদের ক্ষমতারোহন। কোম্পানির কর্পোরেটবাদ মেকলেবাদ মাথা নামিয়ে মান্যতা দেন ঔপনিবেশিক বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য মহারথী। ব্রিটিশ লুঠের কাব্যকার রমেশ দত্ত শেষ জীবন কাটান কিন্তু সভ্য লন্ডনেই - শ্রমকে অবাঞ্ছিত হিসেবে ঘোষনা করা, লুঠেরা কর্পোরেটিয় কেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রযুক্তিকে মাথা নামিয়ে আত্মীকরণ করাই ভদ্রবিত্ততার ভিত্তি।
যতদিন যাচ্ছে কর্পোরেট জ্ঞানচর্চা জাঁকিয়ে বসছে একটু একটু করেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ কর্পোরেট জ্ঞানচর্চার লীলাক্ষেত্র। অধিকাংশ স্নাতক চাকরিযোগ্য নয় এই ধুয়ো তুলে তারা পাঠ্যসূচীতে নাক গলাচ্ছে এবং পাঠ্যসূচীর যতটুকু সামাজিক রেণূ ছিল তাও ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে।
এই পড়াশোনার জন্যে যোগ্য ভদ্রবিত্তরা। তাদের ছানাপোনারাও যোগ্য হয়ে ওঠার প্রাণপন চেষ্টা করছেন।
ফলে কি পড়াচ্ছি গুরুত্বপূর্ণ। যে পাঠ্যসূচী আজ পড়ানো হয় তার ভিত্তি মেকলে ট্রেভলিয়ন, এডমন্ড বার্কবাদ। সেটা মূলত ৬% ভদ্রবিত্ত নির্ভর। এটা আদতে হাতে কলমে কাজ না করা তাত্ত্বিকভাবে কাজ করা ভদ্রলোকিয় অকারিগরিয় পাঠ্যক্রমের ভিত্তি। এ বাংলায় তাদের যে সংখ্যা, সেটা বিশাল। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে তার বাইরে এই পাঠ্যসূচীর যাওয়ার ইচ্ছেও নেই, দরকারই নেই।
মোদি থেকে মমতার মধ্যে থাকা কোটি কোটি পদাধিকারী যদি বিকেন্দ্রিকরণের ভাবনা ভাবেন তাহলে গোটা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে পড়বে। কর্পোরেট উপনিবেশটা দাঁড়িয়ে আছে কেন্দ্রিভবনের তত্ত্বের ওপর - তার মধ্যের এদিক ওদিক একটু ছাড় দেওয়া দেয়ি। সেই বাস্তবতা নিয়েই ব্যক্তিগত উদ্যোগে শ্বাসরোধকর উপনিবেশবাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে যতটা জানালা খোলা যায়।
তার বাইরে আছেন বিপুল পরম্পরার কারিগর, যারা আদতে মূলতই উপনিবেশের বাইরে দাঁড়িয়ে আজও। কর্পোরেটের পায়ে আত্মদান আজকের ঔপনিবেশিক ইংরেজিশিক্ষিত, বুজের মধ্যে একটুকরো ইওরোপ আমেরিকা পুষে রাখা ভদ্রবিত্ত বাঙ্গালির একমাত্র উচ্চাশা।
এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
No comments:
Post a Comment