ওয়ারেন হেস্টিংস লন্ডনের কোম্পানির কোর্টের কর্তাদের নির্দেশে বাংলার অসামরিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের বার্তা পেলেন। ঠিক সেই সময় রাষ্ট্র হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে চলা ব্রিটেনও অসামরিক বিচার, জন শৃঙ্খলা, গতায়াত এবং যোগাযোগ ইত্যাদি বিকাশে উপনিবেশ থেকে আসা রাজস্বের ওপর নির্ভশীল। হেস্টিংসকে দেয় কোম্পানির কোর্টের নির্শনামাটি থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল, গোটা কোম্পানি রাজস্ব ব্যবস্থা আদায়কে সাজাতে হবে ২০০ জন অসামরিক আমলা এবং ১০০০ জন সামরিক বাহিনীর মধ্যে থেকেই। হেস্টিংস বুঝলেন প্রশাসনকে সফল হতে গেলে কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলিতে শেষ বিচারের বইএর মত কিছু একটা বানাতে হবে। তিনি লিখলেন, Every accumulation of knowledge and especially such as is obtained by social communication with people over whom we exercise a dominion founded on the right of conquest, is useful to the state . . .। রাজস্ব এবং আইনএর দিক থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে চুক্তি করা অথবা নতুন জয় করা এলাকায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন লাগু করার জন্যে আইন ইত্যাদি আগামী দশকগুলোয় প্রয়োজন হল বিশদ সঙ্খ্যাতত্ত্ব যা আসবে ভূমিপ্রকৃতি, প্রাকৃতিক ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, স্থানীয় নীতি ও প্রথা, খাদ্য অভ্যেস এবং সাধারণ জীবনযাত্রা বিষয়ে সমীক্ষার তথ্য থেকে।
দক্ষিণ এশিয় এলাকার ভাষা এবং অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জনে উৎসাহী আমলাদের জন্যে হেস্টিংস বিপুল আর্থিক সুযোগ সুবিধের পরিকল্পনা ঘোষনা করলেন। কোম্পানির এই নীতি হেস্টিংসের আগের মূলত ইওরোপিয়দের – সাধারণত মিশনারিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে হত। উপমহাদেশের উদীয়মান শাসক হিসেবে প্রশাসন চালাতে দেশিয় মানুষদের বিষয়ে জ্ঞানার্জনের কাজে বিপুল বিশাল প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সূচনা ঘটল হেস্টিংসের সময়। এতদিন ধরে বন্দুক হাতে নিয়ে শাসন চালানো ব্রিটিশ প্রশাসন তাত্ত্বিকভাবে তথ্য নির্ভর করে প্রশাসন যন্ত্র চালাবার কাজে উদ্যমী হয়ে উঠল। রাজস্ব আদায়, বিচার বিভাগ চালানো এবং শেষ পর্যন্ত শিক্ষা দানের প্রশাসন চালাতে ব্রিটনদের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যবিত্তস্থদের মধ্যে আদান-প্রদান বাড়ল। নানান স্তরের দেশিয় দক্ষিণ এশিয়র সঙ্গে যে মধ্যস্থতার ব্যবস্থা শুরু হল, তার মুল লক্ষ্য হল ব্রিটিশ আমলাদের অধীনে প্রশাসনিক কাঠামো চালানোর কর্মচারী নিয়োগ। বিগত মুঘল প্রশাসন এবং দেশিয় রাজাদের থেকে ধার করা পদগুলির যেমন তহশিলদার, কাজি, পরগনা সেরেস্তাদার/কানুনগো, পাটোয়ারি, আমিল, কাতিব, নাম বজায় রেখে ব্রিটিশ এবং দেশিয় মধ্যস্থদের মধ্যে বেঁটে দেওয়া হল।
তবে সব ধরণের কোম্পানি আমলার হেস্টিংসের ডাকে এবং উতসাহভাতায় সাড়া দেওয়ার মানসিক রেস্ত ছিল না। অধিকাংশ ব্রিটিশ আমলা ভারতে আসত চৌদ্দ থেকে আঠারো বছর বয়সে, এবং তাদের লক্ষ্য ছিল কত তাড়াতাড়ি ভাগ্য বদলে লন্ডনে ফিরে যাওয়া যায়। ঐতিহাসিকভাবে ইংলন্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি পেত মূলত সওদাগর, পেশাদার(মূলত লন্ডনভিত্তিক ব্যাঙ্কিং) আর জমিদারদের কনিষ্ঠ সন্তানটি। এরা বংশ পরম্পরায় বাংলায় কোম্পানির আমলা পদের অতিলাভজনক কেরিয়ার, সন্তানদের মধ্যে একটা আভিজাত্যিক শৃঙ্খলে আপসে বেঁটে নিতেন। কোম্পানি চাকরির উমদোরদের জন্যে চাইত শুধু সাধারণ the rule of three and merchants’ accounts শিক্ষা পাওয়ার শংসাপত্র। এই পরিবারগুলোর অতি খরুচে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার জন্যে বরাদ্দ ছিল পরিবারের জৈষ্ঠ সন্তান, যাদেরা মেট্রোপলিটনের শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে পড়ানো বা উচ্চস্তরের করণিক হবার সাধ ছিল। ফলে এই চাকুরিজীবিরা নিজেদের ভাগ্য ফেরাবার স্বপ্নে এতই মশগুল হয়ে থাকত যে, দক্ষিণ এশিয় মানুষ বা তাদের কৃষ্টি বা জীবনযাত্রা নিয়ে মাথা ঘামাবার কোন অবসরই তাদের ছিল না।
কপিল রাজের রিলোকেটিং মডার্ন সায়েন্স থেকে, ১১০ পাতা
No comments:
Post a Comment