পরম্পরার জ্ঞান, দক্ষতার অমৃতের সন্ধান
গাঁইয়া কারিগরদের কাজকে কোন দিন সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রমিতবাদী ঔপনিবেশিক শহুরে পাশ্চাত্য-শিক্ষিত, শিল্পকলার জ্ঞানচর্চা খুব বেশি গুরুত্ব দেয় তো নিই, বরং ইওরোপের নবজাগরণ যে পাগান কৃষ্টি ধ্বংস করে, যে ভাবে এদের গাঁইয়া জাদুঘরিয়ে তকমা এঁটে ফোক বা লৌকিক শিল্পচর্চা করেছিল, বাংলার ইওরোপের গলবন্ধ পরা প্রাতিষ্ঠানিক লোকশিল্পতাত্ত্বিকেরা দেশের পাগান কৃষ্টি প্রযুক্তি জ্ঞানচর্চা ধ্বংস না করতে পেরে গাঁইয়াদের অশিক্ষিত, অদক্ষ, অশিক্ষিতের পটুত্ব ইত্যাদি ধরণের ছাপ মেরে ঠেলে দিয়েছে বেড়ার ওপারে। সংখ্যাগুরু কারিগরদের কিস্যু যায় আসে নি - বরং যখনই লুঠেরা নবজাগরণের হোতাদের পশ্চিমি অনুপান বিস্বাদ ঠেকেছে তখনই তাদের দক্ষতা ধার নিতে হয়েছে গাঁইয়াদের থেকেই।
এই গাঁইয়া কারিগরেরা শহুরে শিল্পী, নাটুকে বা সিনেমা করিয়েদের মত সরকারি দাক্ষিণ্য, সংরক্ষণ, দাবি করেন নি, কোনদিন অভিমানভরা ফোলানো ঠোঁট নিয়ে বলেন নি কেন তাঁদের তথাকথিতভাবে শিল্পীরূপে গণ্য করে এই কমিটি ঐ কমিটিতে নেওয়া হচ্ছে না, বা নাটক করিয়েদের মত দাবি তোলেন নি কেন তথাকথিত জাতীয় শিল্প করার জন্য বিনামূল্যে জমি, কম পয়সায় প্রেক্ষাগৃহ, নাটক তৈরির জন্য দান বা নিদেনপক্ষে কিছু হাবিজাবিমার্কা উপাধি দেওয়া হচ্ছে না, বা সমাজপাল্টাতে মন প্রাণ ঢেলে দেওয়া বড় পুঁজির 'যোগ্য সন্তান' সিনেমার বাংলার মাটিতে শেকড় গজিয়ে ফেলতে ব্যস্ত পরিচালকদের মত দাবি করেন নি, কেন তাঁদের বিপ্লবাত্মক সমাজপরিবর্তনের সিনেমায় সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালছে না।
না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ১৪১৭ সালে লোকপ্রসার প্রকল্প নেওয়ার আগে, কিছু গবেষক, কিছু সরকারি আমলা, কিছু প্রগতিশীল রাজনীতির কারবারি এদের নিয়ে দাবা খেলাখেলি করা ছাড়া, কেউ এদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করে নি - স্থায়ীভাবে এদের পিঠে 'লুপ্তপ্রায়' শব্দবন্ধটি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে কোন শহুরে কোনদিন এই শিল্পগুলিকে সাহস করে বোঝার চেষ্টা না করেন- তাঁদের মাথায় গুঁজে দেওয়া পড়েপাওয়া চৌদ্দআনা ইওরোপিয় সংস্কৃতির চৌহদ্দির বাইরে এসে।
----
আমার ভাগ্যভাল, বঙ্গীয় পারম্পতিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘে এই মানুষজন জুড়ে নেওয়ার যোগ্য মনে করেছিলেন। দেখছিলাম, কি করে কয়েকশ বছরের বাংলার, হ্যাঁ খুব বড়ভাবে বলছি, গ্রাম-বাংলার শেকড়ের মুখে বসে থাকা একটা পরম্পরার পরিবার শিল্প সৃষ্টি করে।দেখলাম, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, দেখলাম সেই পরিবারের এক প্রজন্ম কি করে এই ভেঙ্গে পড়া হাহুতাশি সময়ে তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা, পরম্পরা, তাঁদের মূল্যবোধ, তাঁদের শিল্প ভাবনা চারিয়ে দিয়ে যান পরের প্রজন্মের মধ্যে। দেখলাম আর শিক্ষিত হয়ে বুঝলাম, গ্রামবাংলা শত ধ্বংস, শত লুঠ, শত ব্যভিচারী তত্ত্বের প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে গেলেও কি করে তার মৌলিকতার কুড়টি টিকিয়ে রাখে নিজের মত করে।
আমার ভাগ্যভাল, বঙ্গীয় পারম্পতিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘে এই মানুষজন জুড়ে নেওয়ার যোগ্য মনে করেছিলেন। দেখছিলাম, কি করে কয়েকশ বছরের বাংলার, হ্যাঁ খুব বড়ভাবে বলছি, গ্রাম-বাংলার শেকড়ের মুখে বসে থাকা একটা পরম্পরার পরিবার শিল্প সৃষ্টি করে।দেখলাম, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, দেখলাম সেই পরিবারের এক প্রজন্ম কি করে এই ভেঙ্গে পড়া হাহুতাশি সময়ে তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা, পরম্পরা, তাঁদের মূল্যবোধ, তাঁদের শিল্প ভাবনা চারিয়ে দিয়ে যান পরের প্রজন্মের মধ্যে। দেখলাম আর শিক্ষিত হয়ে বুঝলাম, গ্রামবাংলা শত ধ্বংস, শত লুঠ, শত ব্যভিচারী তত্ত্বের প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে গেলেও কি করে তার মৌলিকতার কুড়টি টিকিয়ে রাখে নিজের মত করে।
ঘটনাটা হল স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একটি দেশ থেকে গরুর মূর্তি তৈরি করে দেখানোর আহ্বান পেয়েছেন মুষ্কিপুরের মালাকার পরিবার। শর্ত, প্রবীন মধুমঙ্গল মালাকার যাবেন - তিনি অর্থ পাবেন। কিন্তু সামান্য মধুদার শর্ত হল, তার অর্থের প্রয়োজন নেই, তার সঙ্গে যেতে দিতে হবে, না তার একমাত্র শিল্পী সন্তান নয়, তার ভাই, গুরুকিঙ্করের সন্তান গৌরবকে।
নিজের চোখে দেখলাম কি করে একটা প্রজন্ম নব ইংরেজিশিক্ষিত কারিগর প্রজন্মকে হাতে ধরে জ্ঞান, দক্ষতা আর প্রজ্ঞান প্রবাহিত করান, পাশে দাঁড়িয়ে নয়, সাধারণ কিছু নির্দেশ দিয়ে। মধুদা তখন তার দোকানে, গৌরব বাড়িতে গরুটি তৈরি করছে - কিন্তু গলাটা ঠিক মত যা সে চাইছে হচ্ছে না - মধুদা দুপুরে এলেন - নিজের হাতে ঐটুকু অংশ দেখিয়ে দিলেন। তারপর কারিগরের বংশ পরম্পরার রক্ত পুরো ব্যাপারটাকে এঁচে নিয়ে নামিয়ে দিল সেটা দরকার।
এই ঘটনাগুলোর কিছু বিরল ছবি তুলে নিয়ে এসেছি - আমার নিশ্চিন্তিভাবটা কিছুটা চারিয়ে দিতে চাইছি কিছু বন্ধুর মধ্যে যারা আম ইংরেজি শিক্ষিত ইওরোপনম্য শহুরে মানসিকতার বাইরে বেরোতে চাওয়া মানুষদের জন্যে, যাঁরা এই না দেখা, না জানা, না বোঝা, না পড়া নিজের দেশ, গ্রাম, মানুষ, শিল্পকে বুঝতে চান। আবারও বলি আমার ভাগ্য ভাল এই অসামান্য মানুষদের সঙ্গ করতে পেরেছি, তারা কোন বাধা ছাড়াই সযত্নে অশিক্ষিত এই মানুষটিকে তাঁদের কর্মতত্ত্ব বোঝার সুযোগ করে দিয়েছেন।
সেই দীর্ঘদিনধরে সঞ্চিত অমৃতের কিছু ফোঁটা আপনাদের সক্কলের জন্য বেঁটে দেওয়া গেল, গ্রামশিল্পে কোথাও কোন বাধাবন্ধ নেই - সব কিছু বাতাসের মত সূর্যের আলোর মত উন্মুক্ত।
জয় বাংলা!
জয় বাংলার দক্ষতার!
জয় বাংলার জ্ঞান, প্রযুক্তির!
জয় বাংলার পরম্পরার পরিবারগুলোর!
জয় বাংলার দক্ষতার!
জয় বাংলার জ্ঞান, প্রযুক্তির!
জয় বাংলার পরম্পরার পরিবারগুলোর!
No comments:
Post a Comment