Thursday, July 5, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১ - দেশিয় প্রযুক্তিচর্চা, মাটির বাড়ি

ফরিদপুরের মধুখালির ছরোয়ার জান মিঞার মাটির বাড়ি
ছরোয়ার জান মিঞার বাড়ীর কতটা ধারনা নিম্নলিখিত বিবরণে পাওয়া যাইবে।
ঘর খানি চারি চালা বিশিষ্ট, সেদেশে ইহাকে ‘চৌরি’ ঘর বলে। পূর্ববঙ্গে এক রূপ ছন জন্মে তাহাকে ‘উলু ছন’ বলে। এই উলু ছনের উল্লেখ পূর্ববঙ্গ-গীতিকায় অনেক স্থলে পাওয়া যায়। সাধারণ ছন হইতে এই উলু ছন দীর্ঘ সূক্ষ্ম ও অনেককাল স্থায়ী। এই উলু ছনকে খুব কায়দা করিয়া ‘কুলি ছন’ (হিসেবে) তৈরী করিতে হয়। মুঠির মধ্যে উলু ছন এক একটি আঁটি ধরিয়া ধরিয়া তাহা ছাঁটিতে হয়, কোন একটি খড় বড় বা ছোট না হয় এইভাবে বাছাই হয় এবং সমান করিয়া কাটিতে হয়। তৎপরে এই কুলি ছনের এক একটি আঁটি বিস্তৃত করিয়া সাজানো হয়। চালের উপর ছন খুব পুরু করিয়া প্রত্যেকটি স্তর নির্মিত হয়, প্রত্যেক ছয় ইঞ্চি ব্যাপক ছনের স্তরের পর আঁঠন (বাঁশের চটা – উহা খুব সরু করিয়া গোলাকৃতি করে তাহারই নাম ছাওনী কাঠি।)। এইরূপ স্তরে স্তরে কুলি ছন চালের সঙ্গে বাঁধিয়া ঢালা(উপরের দিক) পর্যন্ত লইয়া যাওয়া হয়। উপরের দিকটা ওই ছন মোড় দিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া এমন করিয়া বাঁধে যে তাহা দেখিতে খুব সুন্দর হয়। এই চালের নিচের দিকটায় অতি সরু কারুকার্যময় পাটি থাকে এই পাটিকে পূর্ববঙ্গে শীতল পাটি বলে। ইহার দাম খুব বেশী। কখনো কখনো একখানি দাম ৫০০ টাকা পর্যন্ত হইত। শীতল পাটিতে আটকাইবার জন্য ছাটন(সূক্ষ্মভাবে চাঁচা বাসের চটা) ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি প্রত্যেক চার আঙ্গুল পরে পরে ‘ছাটন’ থাকে, ছাটনগুলির সঙ্গে ‘ফুরসো’(ছাটন হইতে অর্ধগোলাকৃত চাঁচা বাঁশ) বক্র ও আড়িভাবে আবদ্ধ থাকে। এই সমস্ত বাঁধনে কুলি ছন খুব শক্ত ভাবে আঁটা থাকে। ‘ফুরসো’র সঙ্গে সঙ্গে ঘন ঘন পাকা বাঁশের নাতিস্থূল গোলাকৃতি ‘রুয়ো’ আড়াআড়িভাবে বাঁধা হয়, ইহাতে চাল এত শক্ত হয় যে কেহ চালের উপর তান্ডব নৃত্য করিলেও তাহা হেলেনা। রুয়োকে আটকাইবার জন্য বাঁশের চটা সর্বনিম্নে আবদ্ধ হয়, এই প্রশস্ত চটা কে মুখজোত বলে। চালের একেবারে সন্মুখে সাজানো দিকটাকে মুখ পাত বলে। এখন ঘরের মধ্যে গিয়া ঊর্ধ্বে তাকাইলে যে দৃশ্য দেখা যায় তাহা বর্ণনাতীত যে সকল বাঁধ আঁটনের কথা বলা হইয়াছে সেই সমস্তই নানা বর্ণে রঞ্জিত ও তাহার প্রত্যেকটিতে অসীম ধৈর্যের পরিচায়ক শিল্পকার্য্য আছে। বিচিত্র বর্ণের ফুল ও লতাতে উপরকার দৃশ্য অতি মনোরম হয়। নানা কারুকার্যমন্ডিত খুঁটির সঙ্গে কাঠের ডাফ দিয়া চাল আঁটা হয়। ডাফগুলি কোনটি নরাআকৃতি কোনটি হাতির শুঁড়ের মত, কোনোটিতে পরী বা অন্য কোন জীবজন্তুর মূর্ত্তি গড়া থাকে। যেখানে যেখানে বেতের ‘গোরা’ সেখানে সেখানে বিচিত্র বর্ণ পশু পক্ষী ও ফুলপল্লবের কারিগরী। সুন্ধি বেত অতি সুক্ষ্ম ভাবে চাঁচিয়া তাহাতে নানান কায়দা করিয়া লতা পাতা ফুলের আকারে গেঁড়োগুলি(গ্রন্থি) গড়া হয়। নিম্ন হইতে ঊর্ধ্বে তাকাইলে মাঝে মাঝে শীতল পাটি ও বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত গেঁড়ো এবং ঠেকাগুলি অদ্ভুত অদ্ভুত মূর্তিতে এমন শোভাময় দেখায় যে চক্ষু সেই চারু দৃশ্যে ভুলিয়া যায়। খাম্বা অথবা বাঁশের খুঁটিতে যে বাঁশ থাকে এবং যাহার সঙ্গে চাল-আঁটা থাকে তাহাকে পাড় বলে। আবার ঘরের ভিতর চালাকে শক্ত করিয়া এবং উঁচু করিয়া রাখিবার জন্য ডাফের যে সরু বাঁশ দিয়া চালা বাঁধা থাকে সেই বাঁশকে তীর বলে, যে বাঁশের বিস্তৃত চাটার দ্বারা বাঁধা থাকে তাহাকে রুয়ো আঠন বলে। এই শিল্প-শোভা প্রতিপদে অজন্তার ছাতের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়।
ছারওয়ার জান মিঞার খড়ো ঘর, পো মধুখালি, গ্রাম বনমালদিয়া, জেলা ফরিদপুর।
(চলবে)
আগামী লেখায় ছারওয়ার জান মিঞার বাড়ির আরও বিস্তৃত বর্ণনা দেব।
সূত্র, বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খণ্ড, চতুর্দ্দশ অধ্যায়, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 'পরবর্তী শিল্প ও স্থাপত্য'

No comments: