বিনয় লালের মুখবন্ধ
এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য, বহু শিক্ষিত
নবজাগরণের জ্যোতির্বলয়ের বিশ্বাসে বাস করেন। ছোটবেলা থেকেই তাদের বিশ্বাস করিয়ে
দেওয়া হয়েছে যে কোন বিশ্বমানবিকতাবাদের উতস ইওরোপিয় ভাবনা, তারা বিশ্বাস করেন না
যে উপনিবেশ দেশের মানুষের চরম ক্ষতি করেছে, জীবনযাত্রার মানকে ধ্বংস করেছে, কৃষ্টি,
জীববৈচিত্র, এবং সামাজিক উত্তরাধিকারকে দূষিত করেছে। প্রত্যেক উপনিবেশে ঔপনিবেশিক
প্রভুরা তাদের উপনিবেশিকতার তত্ত্ব উপনিবেশের প্রজাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ মন
দিয়ে করেছে। উপনিবেশ এবং উত্তর উপনিবেশিক সময়ে আজ এটা পরিষ্কার করে বলা দরকার,
প্রাথমিক স্তরে উপনিবেশ তৈরি হয় জ্ঞান দখলদারির মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের
প্রথম দুই তিন দশকের কাজ হয় খুব গুরুত্বপুর্ণ কিছু জ্ঞাণী আর বিদ্বানদের মাধ্যমে জ্ঞান
আহরণ করার। ভারত এর একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ, এবং বিশ্বের কোন দেশের এই রকম কাণ্ড ঘটে
নি, তারা প্রথম কয়েক বছর ভারতের সামাজিক এবং বিদ্যা বিষয়ক জ্ঞানচর্চার পরম্পরা
অধ্যয়ন করে, ভারতীয় ভাষাগুলির ব্যকরণ তৈরি হল, বিভিন্ন শাস্ত্রের বচন সুগ্রন্থিত
এবং সেটা যে ঠিক সেটাও তারা বলে দিল, হিন্দু আর মুসলমানেদের আইন লিপিবদ্ধ হল;
দেশের মানচিত্র তৈরি হল, মানবসুমারি হল, তাদের দেহকাণ্ডের আকারের মাপ নেওয়া হল এবং
শ্রেণিবিন্যাস ঘটল; সমাজগুলির সুবারি হল, পরিচিত তৈরি হল এবং নামকরণ ঘটল।
আজকের বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে বিশ্বের
গোটা সমাজকে পশ্চিমি জ্ঞানচর্চা সফলভাবেদখল করে নিয়েছে। আজ বিশ্বকে আমরা যে নামে
যে শ্রেণীতে জানি আর চিনি, সেগুলি মূলত পশ্চিমি জ্ঞানচর্চার দ্বারা সৃষ্ট। এই
প্রাকৃতিক এবং বিশ্বের শুধু বস্তুগত জ্ঞানের শ্রেণীবিভাগই নয়, মানব সমাজের প্রায়
সমস্ত সামাজিক রাজনৈতিক, ধার্মিক, কৃষ্টিগত এবং আইনি জ্ঞানের বৌদ্ধিক নথিকরণ, পড়াশোনা,
ব্যবস্থাপনা, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং প্রবাহিত করেছে উপনিবেশ তাদের স্বার্থ অনুযায়ী।
বিকাশ, দারিদ্র, অভাব এবং উন্নয়ন বিষয়ে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী সব কটা সমাজবিজ্ঞান
চর্চা প্রাধান্য দিয়ে প্রচার করে বিশ্বের প্রায় সমস্ত জ্ঞানের ওপর একচেটিয়া অধিকার
কায়েম করে ফেলেছে। পশ্চিমি সমাজ বিজ্ঞানের মোদ্দা যোগফলটি যে শুধু তথাকথিত
উন্নয়নশীলদেশকে গরীবি নিয়ে কাদা ছোঁড়ার চেষ্টাই নয়, সে বলার চেষ্টা করে, উন্নয়নশীল
দেশের জীবন পশ্চিমের জীবনশৈলীর মত উন্নত নয়। সামগ্রিক উন্নয়নের তত্ত্ব সময়ফাঁকে উপনিবেশের
নেটিভটি ঢুকে থাকে। তাদের নিদান অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের একাংশ গোটা উন্নয়নশীল
দেশের বিকাশের পথ অনুসরণ করুক। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলই যখন উন্নতদের কাছাকাছি পৌঁছবে
ততক্ষণ সে তাদের ছাড়িয়ে আরও উন্নত স্তরে পৌঁছে যাবে। উন্নয়নের তত্ত্ব উপনিবেশের মানুষদের পরম্পরার জীবনযাত্রায় জীবন কাটাতে
দেয় না, তাকে উপনিবেশের শাসকদের জীবনযাত্রার ধারণা ধার করে বাঁচতে হয়। উপনিবেশ তার অতীতে ঝুঁকে দেখার
মানসিকতাটাই কেড়ে নেয় আর বিশ্বায়ন আর ভবিষ্যতের জীবনে থাবা মারে। নেটিভের বর্তমান
যদি ইওরোপিয়র অতীত হয়, তাহলে নেটিভের ভবিষ্যত ইওরোপিয়র বর্তমান।
সাম্প্রতিক অতীতের বিশ্বায়ন সংক্রান্ত
বিপুল বিশালাকার নানান তাত্ত্বিক গবেষণায় কখোনোই স্বীকার করা হয় নি বিশ্বায়নের সব
থেকে পড় পণ্যটাই হল (প্রাচ্যের জ্ঞানচর্চা লুঠ করে) পশ্চিমের তৈরি জ্ঞানচর্চার
পদ্ধতিটি। আজ যে কোন উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মীর সব থেকের বড় কাজ হল, পশ্চিম
যে জ্ঞানচর্চার ধারাটা উপনিবেশের ওপর কয়েকশ বছর ধরে চাপিয়ে দিয়েছে, সেই চাপানোর ফল
কি সমাজগুলীতে পড়েছে যে বিষয়ে গবেষণা করা। আদতে গোটা ব্যাপারটা হল পাঠসূচী আর
জ্ঞানচর্চা থেকে ঔপনিবেশিক উপাত্ত, পদ্ধতিগুলিকে ছেঁটে ফেলা। আধুনিক পশ্চিমেরর
জ্ঞানচর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তারা অন্য কোন জ্ঞানচর্চার অস্তিত্বই স্বীকার
করে না, জ্ঞানচর্চার বহুত্ববাদে তাদের আস্থা নেই। আধুনিক পশ্চিম তার জয়যাত্রায় কোন
ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের কৃষ্টিকে অস্বীকার করতে চায়? একটা উদাহরণ নেওয়া যাক –
গ্যাটেকে পশ্চিমি মানবতাবাদের চরমোতকর্ষ হিসেবে দেখা হয়, তিনি কবি, ঔপন্যাসিক,
নাট্যকার এবং প্রখ্যাত-বিখ্যাত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। বলা হয় না তিনি মানব
শরীর, পশু, পাখি, গাছ, খণিজ। পাহাড়, জীবাশ্ম রঙ এবং আলো নিয়েও উৎসাহ দেখিয়েছিলেন।
কেননা তিনি প্রখ্যাত তিন প্রত্যক্ষ্যবাদী বেকন, নিউটন, দেকার্তএর তত্ত্বের
বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন – natural objects
should be sought and investigated as they are and not to suit observers, but respectfully as if they
were human beings (David Seamon আর Arthur
Zajoncএর Goethe’s Way of Science: A Phenomenology of Nature থেকে)। আধুনিক বিশ্ব এই তত্ত্বে বিশ্বাসই করে না। তাকে সবার আগে প্রকৃতির ওপর
প্রভুত্ব করতে হবে। নইলে আধুনিকতার রথ চলে না।
No comments:
Post a Comment