এর আগে আমরা টিপুর সুলতানের গ্রন্থাগার বা বেশ কিছু মাস আগে মুঘল প্রযুক্তি ইত্যাদি নিয়ে বেশ কিছুবার আলোচনা করেছি। কিন্তু ব্রিটিশপূর্ব সময়ে বিজ্ঞান ভাবনা আলোচনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার, যা হয়ত খুব শ্রুতি মধুর হবে না। কিন্তু কারিগরদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এই কথাগুলি বলাদরকার বলে আমরা মনে করছি।
ভারতজুড়ে যেমন বিভিন্ন রাজা এবং সংগঠনের দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা জ্ঞানচর্চার প্রবাহ গড়ে উঠেছিল, তেমনি মাঠে ঘাটে অপ্রথাগত পরম্পরার জ্ঞানের সমাহারে গড়ে উঠেছিল চাষ, ঝিল কাটা, জল সংরক্ষণ, সেচ ব্যবস্থা, সহ হাজারো কারিগরি উতপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি, তার হাতিয়ার, তাঁর জ্ঞানচর্চার ধারা - যার ধারকবাহক ছিলেন কারিগরেরা, যারা আজও আছেন সাধারন মুখ না চেনা, নাম না জানা মানুষ হিসেবে, যাদের আমরা ভদ্রবিত্তরা এককথায় অশিক্ষিত বলতে ভালবাসি।
এই জ্ঞানচর্চায় রাজা রাজড়ার পৃষ্ঠপোষকতা কিছুটা থাকলেও এটি আদতে সামাজিক কর্ম ছিল, আছে থাকবে। তাই রাজছত্র ভেঙ্গে পড়লেও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রযুক্তি ইত্যাদি উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করতে কোন বাধা ছিল না। এখানে ছিল না কোন গ্রন্থাগার, ছিল না পুঁথি, ছিল না কোন গবেষণাগার। শুধু পরম্পরারর জ্ঞান, দক্ষতা প্রজ্ঞা, চাহিদার তথ্য কাজে লাগিয়ে পুরুলিয়া বা রাজস্থানে গড়ে উঠেছিল বিশাল বিপুল সেচ ব্যবস্থা(বাঁধ নামক হ্রদ আজও রাঢ বাংলায় আছে কিন্তু হতোদ্যম), শাঁখারিদের জন্যে শাঁখের করাত, তাঁতিদের জন্যে মসলিনের তাঁত, বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন আকারের পুকুর, নানান ধরণের মাটির বাড়ি, চাষের জন্যে ভিন্নভূপ্রকৃতির জন্যে ভিন্ন ভিন্ন হাল, নানান প্রকৃতির জন্যে নানান ধরণের মাছ ধরার জাল, খাওয়ার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন ভূপ্রকৃতি অনুসারে খাদ্যব্যবস্থা, মহিলাদের কাঁথা সেলাই বা আলপনা দেওয়া যা আদতে তাঁদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধারনার প্রতিফলন এবং চরমতম দক্ষতার নজির। আজ যখন আমরা প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান আর জ্ঞানচর্চা নিয়ে আলোচনা করছি, তখন রাজছত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা, বিপুল বিনিয়োগের বাইরে চলমান জ্ঞানচর্চার ধারক এই নাম না জানা সামাজিক মানুষ, যাদের কল্যানে বাংলা তথা উপমহাদেশের সভ্যতা আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে, তাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাবে।
তাঁরা আর আজও ক্রিয়াশীল রয়েছেন। আমাদের চারপাশে রয়েছেন সদা উদ্ভাবনশীল কারিগর, গত কয়েক দশকে যাদের উপহার ইঞ্জিন রিক্সার মত জটিল প্রযুক্তিগত কাজ।
এ নিয়ে প্রচুর জ্ঞানী মানুষ বিশদে কাজ করেছেন, প্রণম্য ধরমপাল পথ দেখিয়ে গিয়েছেন, যেমন সদ্য প্রয়াত অনুপম মিশ্র পুকুর আর রাজস্থানের জল ব্যবস্থা নিয়ে বিপুল কাজ করেছেন, যেমন করে চলেছেন Joya Mitra, Indrajit Chaudhuri, অশোক কুণ্ডু বা নারায়ণ মাহাতর মত প্রখ্যাত বা নাম না জানা মানুষ যাদের কাজের ব্যপ্তি শুষ্কপাঠ্যক্রম, শুধু চাকরি, অধ্যাপনার কেরিয়ার নির্ভর জগতের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে মাঠেঘাটে কাজ করা কারিগরদের মধ্যে।
ব্রিটিশ পূর্ব বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জ্ঞানচর্চা আলোচনায় আজও এই সামাজিক কারিগর নির্ভর জ্ঞানচর্চা যথেষ্টভাবে ক্রিয়াশীল এটা আমাদের মনে রাখা দরকার।
No comments:
Post a Comment