অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
পাগলা কুত্তা আর
ব্রিটিশ মধ্যাহ্নে রাস্তায় হাঁটে
উনবিবংশ শতের
প্রথমভাগে দেখলাম জাহাজে দীর্ঘ সময় কাটাবার জন্যে তো বিপুল জামাকাপড় আনতে হত,
কিন্তু এই হিসেবে ভারতে জীবন অতিবাহিত করার জন্যে যতদূর সম্ভব লন্ডন থেকে খুব বেশি
জামাকাপড় আনা হত না কেননা ভারতের আবহাওয়া লন্ডনের থেকে এক্কেবারে আলাদা। গিলক্রিস্ট
ভারতে যাওয়া মহিলাদের জন্যে ১৫টা ফ্লানেল পেটিকোট এবং কোম্পানির অসামরিক পুরুষ
কর্মচারীদের ওয়েস্ট কোট তৈরির জন্যে ১৫ গজ ফ্লানেল নেওয়ার নিদান দিয়েছেন। আর ভারতে
ঠাণ্ডা মরশুমের সন্ধ্যের সময়টুকুর জন্যে ফ্লানেল আর ওয়েস্ট কোট, এই দু’রকমের নিদান
দিয়েছেন। কিন্তু ভারতীয় আবহাওয়ায় অন্য কাপড়গুলোর কি উপকারিতা সে কথা কিন্তু বলেন
নি ড জেমস জনসন।
ভারতে এবং ওয়েস্ট
ইন্ডিজে চাকরি করা নাভাল সার্জন জনসন বিশদে আলোচনা করেছেন ভারতের আবহাওয়া কিভাবে
একজন ইওরোপিয়র দেহে প্রভাব ফেলে। বইটি ১৮১৩ সালে প্রকাশিত হয়। জনসন লিখছেন, যখন কোন
ইওরোপিয় গ্রীষ্মমণ্ডলের দেশে ঢোকে, যে তখন লিলেনকে বাহুল্য মনে করে বর্জন করে।
অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতকে লিনেন ছিল ইওরোপিয়দের চলতি অন্তর্বাসের তন্তু।
গ্রীষ্মমণ্ডলে লিনেন পোষাক ভিজে গায়ে চেপে বসে এবং তারপরে যখন ঠাণ্ডা হাওয়া বয়,
তখন শরীর আউলিয়ে ওঠে। তিনি বলছেন তিনটে যুক্তিতে ফ্লানেল পরিত্যজ্য – এটা খুব
ভারি, দেহের তাপ আবহাওয়াইয় খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে দিতে পারে না, এবং সব থেকে
গুরুত্বপূর্ণ, চামড়ায় বিরক্তিকরঅনুভূতি তৈরি করে। তা সত্ত্বেও বহুকাল ধরে ভারতীয়
আবহাওয়ায় লিনেনের পরেই ফ্লানেলের কাপড় পরার নিদান দেওয়া হয়েছে।
গ্রিকদের সময়
থেকে উনবিংশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত দেহাভ্যন্তরের গরম নিয়ে নানান ধরণের তত্ত্ব
চালু ছিল – যেমন এটি হল হৃদয়ের মধ্যে লুকিয়ের থাকা গুরুত্বপূর্ণ আগুণ, যাকে বাইরের
বাতাস নিয়ে বাষ্প, পিত্ত, মুত্র, কফ এবং ঘামের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করতে হয়। শ্বাসপ্রশ্বাস
শুধু যে দেহকে ঠাণ্ডা করে তাই নয়, মনে করা হত চামড়াটা নিজেও শ্বাস নেয় ছাড়ে। মনে
করা হত চামড়ার ফুটোগুলির দুটো কাজ, বাইরের ঠণ্ডা হাওয়া ঢোকানো আর দেহের বর্জ্য
পদার্থ ঘাম আর বাষ্পের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেওয়া। বহু কাল ধরে বৈজ্ঞানিক
এবং ডক্টরেরাও বিশ্বাস করতেন শ্বাস্প্রশ্বাস দু ধরণের একটা দেখা যায় অন্যেটা বোঝা
যায় না – যাকে অনুভূতির অগোচর শ্বাস বলা হয়েছে। অনুভূতির অগোচর শ্বাসের মাধ্যমেই
মলত্যাগ ঘটে। যদি নানান দেহের ক্রিয়াকর্ম আটকে দেওয়া যায় তাহলে অসুস্থতা এবং রোগ হয়।
ফলে রোগের চিকিতিসার জন্যে, দেহের ছিদ্রপথের বাধা দূর করার জন্যে মোটা কাপড়, মোটা
বিছানার চাদর, গরম পানীয়, গরম ঘর প্রয়োজনীয়।
শ্বাসপ্রশ্বাসের
এই তত্ত্বের সঙ্গে আরও জুড়ে ছিল দেহের অভ্যন্তর থেকে দূরে থাকা অঙ্গগুলো। ধরা যাক
কোন একজন মানুষ রোদে বেরোনোয় দেহের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি হয়েছে। ঠাণ্ডায় ফিরে
ঠাণ্ডা জল খেয়ে তার দেহের তামাত্রাকে ৯৯তে নামিয়ে আনলেন, সে সময় বাইরের ত্বক,
দেহের জঠর থেকে বেরোনো তরলের প্রতি সিম্প্যাথি তৈরি করার ফলে হাল্কা ঘাম বের করিয়ে
দেয় এবং দেহের তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রিতে নামিয়ে আনে।
বিভিন্ন অঙ্গের
অনুমতিতে শ্বাসপ্রশ্বাস হয়, এই তত্বটা বিংশ শতক পর্যন্ত চিকিৎসা শাস্ত্রে
ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ছিল এবং এর চিন্তার প্রভাব পড়ত ভারতে এবং অনান্য
গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় ইওরোপিয়রা কি ধরণের জামাকাপড় পরবে তার ওপরেও। চিকিৎসক, ভারতে
থাকা পুরোনো ইওরোপিয়, গ্রীষ্মমণ্ডলের জামাকাপড় তৈরি করা দর্জি, আর এই সব অঞ্চলে
ঘুরতে যাওয়ার নির্দেশিকা সম্বলিত পুস্তিকা লেখক প্রত্যেকেই ভারত ঘুরতে যাওয়া
মানুষদের একবাক্যে চামড়ার সঙ্গে লেগে থাকা তন্তু হিসেবে ফ্লানেলএর নিদান দিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, বলা হচ্ছে কাপড়ের তলার অন্তর্বাস হিসেবে ফ্লানেলের কাপড় পরিধান করলে
আবহাওয়ার হঠাত পরিবর্তনকে সহজেই মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এও বলা হচ্ছে, আমি নিশ্চিত,
ভারতের মত আবহাওয়ায় এর উপাদেয় বস্তুটি পরার থেকে আরাম আর অন্য কোন দুটোতে নেই।
ইন্ডিয়ান
মেডিক্যাল সার্ভিসেসের শল্য চিকিৎসক এবং ১৮৭৩ সালে ভারতের মত অস্বাস্থ্যকর এবং
ডাক্তার, ডাক্তারের ছরি কাঁচি নিদান থেকে দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা ইওরোপিয়দের জন্যে
নির্দেশ পুস্তক লেখার জন্য সম্মান পাওয়া ডবলিউ জে মুরের আ ম্যানুয়েল ফর ফ্যামিলি
মেডিসিন ফর ইন্ডিয়ার নামক বইটি ১৯২০ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটা সংস্করণ অস্বাস্থ্যকর ভারতের
কি করিতে হইবে’র নির্দশাবলী হিসেবে কাজ করেছে। তিনি অশ্বারোহীদেরও বলছেন এমন কি
গ্রীষ্ম পরিবেশে কর্ডের ব্রিচ এবং ফ্লানেল পরতে সঙ্গে ফ্লানেল বা সুতোর একটা
ওভারকোট পরতে।
শোলাটুপির
আবিষ্কর্তা ড লুকিয়াস জেফারিস ভারতের ইওরোপিয় সেনাবাহিনীতে জামা কাপড়ের সঙ্গে স্বাস্থের
সম্পর্ক নিয়ে বিশদে কাজ করেছেন। তার যুক্তি সেনাবাহিনীতে যারা কাজ করে, বিশেষ করে
অগ্রগামী বাহিনী(ক্যাম্পেইনার)র চাকরির সঙ্গে পরিবেশে তাপ বেরোনো এবং গ্যাস
নির্গমনের জন্যে একটা মাধ্যম প্রয়োজন হয়। ফ্লানেলের প্রাকৃতিক চরিত্র এই তন্তুকে
এই কাজের জন্যেই বানিয়েছে কারণ এটা ধীরে তাপ পরিবাহী, ছিদ্রবশিষ্ট এবং স্পঞ্জের
মত। এই চরিত্রের জন্যেই ফ্লানেল চামড়ার মধ্যে মধ্যধারক হিসেবে কাজ করে। সে বাতাস
থেকে অতিরিক্ত তাপ দেহে ঢুকতে বাধা দেয় এবং খুব তাড়াতাড়ি দেহ ঠাণ্ডা হতে দেয় না
কারণ সে সব ধরণের স্পর্শযোগ্য শ্বাস নিতে দেহকে সাহায্য করে। হাত পা সহ সারা দেহ
জুড়ে ফ্লানেলের অন্তর্বাস পরার নিদান দিলেন তিনি। তিনি বললেন, সাত বছর ধরে এই কাপড়
পরে তিনি কলেরা, বাহ্য এবং জ্বর থেকে মুক্ত আছেন।
No comments:
Post a Comment