সমাজ বিজ্ঞান পাঠ্যের বিবর্তন
১৮৩৫ সালের টমাস মেকলের এবং ১৮৯২ সালের
আমেরিকার কমটি অব টেনের প্রস্তাবনা
পশ্চিমি
জ্ঞানচর্চার বেদিতে সামগ্রিক নড়বড়ে চলতশক্তিহীন বৌদ্ধিক, ব্যক্তি শিক্ষক এবং
সামগ্রিক ইংরেজি শিক্ষিত সমাজের আত্মসমর্পণ করে বলে তারা রাজনৈতিক স্বাধীনতার
দাবিতে সাধারণত উচ্চকিত হয় না। কারণ তারা শুধু ইংরেজি বোঝে। বৃহত্তর সমাজের থেকে
তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তারা যেহেতু বৈদেশিক পঠন বর্গ নিয়ে কাজ করেছেন, এবং
নিজেদের নয় বৈদেশিক শর্তেই নিজেরা কাজ করেছেন, এবং তাদের অবস্থানে দেশিয় অভিজ্ঞতার
ভূমিকা প্রায় নেই বললেই চলে, তাই তাদের বৈদেশিক চাপে ভঙ্গুর হয়ে পড়া নিজেদের সমাজের
রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার বেদনা তারা বুঝতে পারেন না।
বৈদ্ধিক
ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছে আম্রিকিয় ভারতীয়, নিউজিল্যান্ডের মাওরি এবং
অস্ট্রেলিয়ার আদবাসী এবং আফ্রিকিয় দেশের নানান প্রান্তিক সমাজ থেকেই।
এই
বিরোধিতা এসেছে ইসলামের ভাষ্যে। কারণ বহু ইসলামি সমাজই ধর্মীয় পরম্পরার সঙ্গে
পশ্চিমি(সেকুলার, প্রত্যক্ষ্যবাদী এবং বস্তুবাদিতায়চরমভাবে নিষিক্ত) জ্ঞানকে
মেলাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে এবং সে আজও সঠিকভাবে তার পথ নির্বাচন করতে পারে নি।
মুসলমান পশ্চিমি জ্ঞানচর্চার শংসাপত্র বহুকাল ধরে নিচ্ছে। এমনকি মালেশিয়ার মত
উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের নেতাসম দেশ, সেখানেও তারা পশ্চিমি জ্ঞান নিয়ে
স্কিজোফ্রেনিকভাবে এগোচ্ছে, পশ্চিমের অন্ধকার সময়ে ইসলাম আর বিজ্ঞান যেভাবে হাত
ধরাধরি করে এগিয়েছিল, সেই সময়টাকে আজ তারা ধরতে পারছে না। পশ্চিম আল্লার অস্তিত্ব
অস্বীকার করলেও বস্তুবাদী পশ্চিমি জ্ঞানের সঙ্গে বিভিন্ন ইসলামি দেশের
বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বও পড়ানো হয়।
ভারতের
বৌদ্ধিক মাফিয়ারা ইওরোপিয় সমাজ বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রম কোন প্রশ্ন না তুলে
আত্মীকরণ করে পশ্চিমের পায়ে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের বৌদ্ধিক চেতনার পরাজয় ঘোষনা
করেছেন। দেশের সূক্ষ্মবুদ্ধির মানুষেরা আইআইটিতে ভর্তি হন – ১৩টা শিক্ষা কেন্দ্র আদতে
পশ্চিমি জ্ঞানের, বিজ্ঞানের এবং উতপাদন ব্যবস্থার চর্বিতচর্বণ করে সাদা কলারের শ্রমিক তৈরির জন্যে
তৈরি হয়েছে।
বিশ্ব
অর্থনীতিতে আমেরিকার দবদবা বাড়ার পরে, সমগ্র পাঠ্যক্রম তৈরির বৌদ্ধিক কার্যক্রম
সরে গেল ইওরোপ থেকে আমেরিকায়। আমেরিকা হয়ে উঠল সারা বিশ্বের উত্তরঔপনিবেশিক
বৌদ্ধিক সমাজের গন্তব্যস্থল। এমন কি ব্রিটিশেরাও গেল। সারা বিশ্বের পড়াশোনার
পদ্ধতির মধ্যে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এমন একটা দেশ, যেটির
বিশ্বদৃষ্টি অর্থে সাদা পুরুষদের চিন্তাভাবনা ভিত্তিক। তারা সে দেশের অন্যান্য
জনসঙ্খ্যাকে কুণ্ঠাহীন একতরফা হিংসাত্মক কাণ্ডে দমন করে নিজেদের মুল অর্থনীতির
চালিকাশক্তি হসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উনবিংশ
শতাব্দের সাদা আমেরিকার শিক্ষা পদ্ধতির সমস্যা হল, বিভিন্ন বিদ্যালয়ে মহাবিদ্যালয়ে
যে বিষয় এবং ভাবনাগুলি পড়ানো হচ্ছে তার মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকা। ১৮৯২ সালে সেই
বৈচিত্রকে বদলদাবা করা নিয়ে কমিটি অব টেন তৈরি হয় ১৮৯২ সালে হার্ভার্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট চার্লস এলিয়টের নেতৃত্বে। উদ্দেশ্য হল নিজেদের দেশের
যুবাদের এবং বিশ্ব জ্ঞানচর্চা জগতকে ডমিনেট করতে কি ধরণের বিশ্ববিদ্যালয়ী শিক্ষা
ব্যবস্থা সেটির প্রস্তাবনা তৈরি করা। এই কটির সুপারিশের সূত্র ধরেই আজও বিশ্বজুড়ে
আমেরিকা শিক্ষা ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। কি কি ধরণের বিষয়, তার পড়ানোর
সময়ের ব্যপ্তিও কমিটি নির্ধারণ করে দেয়। প্রাথমিকভাবে নয়টিবিষয় নির্ধারিত হয়, ১।
ল্যাটিন, ২ গ্রিক, ৩। ইংরেজি, ৪। অন্যান্য অধুনিক(ইওরোপিয়) ভাষা, ৭। ইতিহাস, ৮।
ইতিহাস, নাগরিক সরকার এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি, ৯। প্রাকৃতিক ভূগোল, ভূতত্ত্ব এবং
আবহাওয়াবিজ্ঞান।
এখানে
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সব দেশের, সব পরিবেশের, সব বৌদ্ধিক পরম্পরা এবং কৃষ্টি আর
ঐতিহ্যের পড়ুয়াদের এক ধরণের পাঠ্যসূচী পড়ানোর নিদান আজও প্রশ্নের মুখে পড়ে নি। কোন
প্রশ্ন ছাড়াই সারা বিশ্বে এই শিক্ষা পদ্ধতির নকল হল। তার কারণ আধুনিক
বিশ্ববিদ্যালয়ী কৃষ্টি আদতে হনুকরণের পরম্পরা বহন করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ
আফ্রিকার চিন্তাবিদ Ngugi wa Thiong’o
স্পষ্ট বলেছেন আফ্রিকার সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন হনুকরণের নকল এবং
কাকাতুয়ারমত শিখিয়ে দেওয়া পাঠ্যক্রম উগরে দেওয়ার কাজ করে চলেছে। একশ বছর আগে
রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য।
এই নব্য
সংস্কৃতিতে ছাপা বইএর রমরমা বাজার শুরু হল, ছাপা বইএর বাইরে আর কিছুর ধারনাই রইল
না, কারণ, মাঠেঘাটে গিয়ে শেখাএ কোন ব্যাপার নেই। পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বই পড়,
বিদ্যেদিগগজ হও এবং সামাজিক বাস্তবতা থেকে আলাদ হয়ে থাক। আর যেহেতু পাঠ্যে স্থানীয়
অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হল না, সেহেতু একে বিশ্বায়িত পাঠ্যক্রমের মর্যাদা দেওয়া হল।
শুধুই তত্ত্ব, তত্ত্ব আর তত্ত্বের সমাবেশ।
No comments:
Post a Comment