অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
মহিলাদের
পরিচ্ছেদ এবং ইওরোপিয় ধারণায় শালীনতা
মিশনারিদের
নাদারদের ধর্মান্তরকরণের পাশাপাশি আরেকটি উদ্যম ছিল, সেটি হল হিদেনদের তৈরি এই
ঘৃণিত জাত ব্যবস্থা থেকে উদ্ধার। তারা মনে করল এই কাজটি করতে পারলে নাদারেরা
রাজ্যের রাজার অধীনে থেকেও নিজেদের আলাদা সমাজ তৈরি করতে পারবে, চ্যাপেলে,
বিদ্যালয়ে, চার্চে ইত্যাদিতে যেতে পারবে এবং নিজেদের অবস্থা উন্নত করে সমাজে
নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে পারবে। যেহেতু কোম্পানির ক্ষমতা দিনের পর দিন বাড়ছিল তাই
সাধুরা কোম্পানির রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে রাজা আর তাঁর পরামর্শদাতাদের প্রভাবিত
করতে শুরু করে। সাধারণত রাজার আমলারা মূলত নায়ার আর নাম্বুদ্রি প্রবার থেকে আসা।
তাদের কাজে লাগিয়ে নাদারদের উঁচু জাতের মর্যাদা দাবি করল পাদ্রিরা।
সাধুদের স্ত্রীরা
জ্যাকেট ডিজাইন করে তৈরি করিয়ে সেগুলি শ্লীল পরিধেয় হিসেবে খ্রিষ্ট মহলাদের কাছে বিক্রি
করছিলেন। কিন্তু নাদার মহিলারা নায়ারদের মত বক্ষাবরণী পরতেই পছন্দ করছিল। ১৮২০
সালে বাজারে এবং জনসমক্ষে বেশ কয়েকটি ঘটনায় নাদার মহিলাদের কিছু ব্যক্তি আক্রমন
করে তাদের বক্ষাবরণী খুলে দেয় এবং শ্লীলতাহানি করে এবং মারধোরও করে। চ্যাপেল আর
বিদ্যালয়েও আগুণ ধরয়ে দেওয়া হয়। ১৮২৮ সালে হিংসা রুখতে প্রসাসন নাদার মহিলাদের
নায়ারদের বক্ষাবরণী পরা বারণ করে খ্রিষ্টদের মপ্ত জ্যাকেট পরার নির্দেশ জারি করে।
রাজা বললেন নাদার মহিলাদের অন্যান্য নিচু জাতের মতই উচ্চবর্ণের বেগার খাটতে হবে
এবং রাজ্যের প্রথা অনুযায়ী নাদারদের ধর্মান্তরকরণের আগে যা করত তাইই করতে হবে।
১৮৫৯ সালে
ত্রিভাঙ্কুরে আবার গণ্ডগোল শুরু হল। ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জেনারেল কালিন মাদ্রাজ
সরকারকে লিখলেন, শানার মহিলারা শূদ্র(নায়ার)দের মত কাপড় পরায় এলাকায় এলাকায় হিংসা
ছড়িয়ে পড়ছে। কালেন ব্যাখ্যা করে বললেন বহু নায়ার ইংলন্ডের রানীর ১৮৫৮ সালের
নির্দেশিকাকে ভুল বুঝে মনে করছে তারা সরাসরি ব্রিটেনের অধীনে চলে এসেছে। তার সনদে
তিনি বলেছিলেন আমাদের মতই, আমাদের দেশিয় রাজাদের অধিকার সম্মান এবং গৌরব রক্ষা
করতে হবে এবং আরও বললেন আইন তৈরি করতে হবে এবং সেগুলি যথেষ্ট সম্মান দিয়ে রক্ষাও
করতে হবে এবং ভারতীয় প্রথা নীতি অনুযায়ী প্রাচীন অধিকার রক্ষা করতে হবে। এই সনদ
বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুলভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নায়ার এবং আমলারা মনে করল
এই সনদের দ্বারা জাতি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার তাদের সব ধরণের বন্ধ হয়ে যাবে এবং তাই
নয় আগের যত প্রথা ছিল সব উঠে যাবে।
যদিও কালেন
ভাবছিলেন তিনি রাজাকে বলে নায়ারদের মত কাপড় পরা বন্ধ করার নির্দেশ দেবেন নাদার এবং
অন্যান্য নিচু জাতের মহিলাদের, ওদিকে আবার মাদ্রাজ সরকার ইংলন্ড এবং ভারতের
মিশনারিদের চাপে পড়ে কালেনকে বললেন আমরা যদি ত্রিভাঙ্কুরের রাজার বিরুদ্ধে কঠোর
পদক্ষেপ না নিতে পারি তাহলে গোটা সভ্য জগত আমাদের ক্ষমা করবে না।
মাদ্রাজ সরকারের
চাপের কাছে পুরোপুরি মাথা নত করলেন না মহারাজা শুধু বললেন আগে শানার মহিলাদের ওপর
যে ধরণের বর্বর আচরণ করা হয়েছে সেটার শেষ দেখতে হবে। ১৮৫৯ সালেরর ২৬ জুলাইএর সনদে
তিনি বললেন নাদার ধর্মপরিবর্তনকারী মহিলাদের যে সুবিধে দেওয়া হয়েছে সেই সুবিধে সব
ধরনের নাদার মহিলাকে দেওয়ার আইন হল, যাতে তার কোন প্রজা অখুশি না থাকে, সক্কলে
খ্রিষ্ট নাদারদের মত জ্যাকেট পরবে, প্রত্যেকে মোটা সুতির কাপড় পরবে এবং নিচু জাতের
জেলে মাক্কাভাট্টিগাল জাতের মহিলারা শরীর ঢেকে ঊর্ধাংশ জড়িয়ে কাপড় পরেন তারাও
সেরকম কাপড় পরতে পারবেন তবে উচ্চজাতির কাপড় পরার আঙ্গিক নকল করা যাবে না। এই
অধিকার ছড়িয়ে দেওয়া হল ইরাভার এবং অন্যান্য ছোট জাত যারা খুব তাড়াতাড়ি
খ্রিষ্টধর্মান্তরিত হয়ে যাচ্ছে।
মিশনারিরা এই
সমাধানে খুশি হল না। তারা একে প্রতিক্রিয়াশীল আইন বলল। লন্ডন মিশন সোসাইটির
রেভারেন্ড স্যামুয়েল মাটির লিখলেন ত্রিভাঙ্কুরে খ্রিষ্ট প্রোটেস্টান্ট মহিলারা
সমাজে উচ্চ সম্মান লাভ করেন। তারা শিক্ষিত এবং শুদ্ধ, তারা যে লেস তৈরি করে তা এতই
উচ্চমানের যে নানান প্রতিযোগিতায় তারা মেডেলও পেয়েছেন। তবু তাদের মোটা কাপড় পরতে
বাধ্য করা হয়, যা স্তনের ওপর বাঁধা হয় এবং হাত আর কাঁধ গোটাটা উন্মুক্ত থাকে –
শালীন নয়। আদতে এটা জেলে মহিলাদের পোষাক, যাদের নাদারেরা নিচু জাত হিসেবে দেখে।
মাটির বললেন কাপড় নিয়ে আইন করা আদতে সভ্যতার অগ্রগতির বিরোধী আর হাতে বোনা মোটা
কাপড় পরতে বাধ্য করা একটি আত্মঘাতী নীতি যা ব্যবসা বাণিজ্যকে ধ্বংস করবে।
উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৯৮
ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং তার জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক
সাম্রাজ্যের মন ও মান ।। বারনার্ড কোহন
অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
মহিলাদের
পরিচ্ছেদ এবং ইওরোপিয় ধারণায় শালীনতা
পরিষ্কার যে
নাদারেরা এই নিষেধ অমান্য করেই এমন একধরণের কাপড় পরা শুরু করল, যা উচ্চশ্রেণীর
হিন্দুদের অনুকরণে তৈরি। দেওয়ান এবং পেশকার(উচ্চপদের রজস্ব আমলা) এবং ১৮৫৯এর ঘটনায়
ব্যক্তিগতভাবে জুড়ে থাকা পি এস মেনন লিখলেন, শানার ধর্মান্তর হওয়া মানুষেরা যেভাবে
জামাকাপড় পরা শুরু করল, তাতে হিন্দু(উচ্চচবর্ণ) জনসমষ্টি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। তিনি
মনে করলেন শুধু নায়ারদেরই অপমান করা নয়, খ্রিষ্ট মিশনারীরা সরাসরি গোটা হিন্দু
সমাজকেই উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে অপমান করছে। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী মিশনারীরা তাদের গায়ের
রঙ এবং জাতীয়তার যোগাযোগকে ব্যবহার করে মাদ্রাজ সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে,
নাদারদের জন্যে এমন একটা পোষাক পরিকল্পনা করল যাতে হিন্দুদের আত্মা খ্রিষ্ট ধর্ম
বিরোধী হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই ত্রিভাঙ্কুরের ধর্মপরিবর্তনকারীদের পাশে ব্রিটিশ
সরকারের সমর্থ আদায় করে। তার ভাবনা সত্যিও হতে পারে কেননা মাটির বলেছিলেন
তিন্নাভেল্লি(ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চল)তে যতক্ষণনা সব শ্রেণীর হিন্দু তাদের ব্যক্তিগত
ইচ্ছে মত পরিধেয় পরার বিষয়ে স্বাধীনতা অর্জন করছে, ততক্ষণ এই বিতর্কটির সমাধান হবে
না।
ঐতিহাসিক আর এন
য়েসুদাসের লেখাতেও বক্ষাবরণী বিতর্ক উঠে এসেছে। য়েসুদাসের মার্ক্সীয় শ্রেণী সংগ্রামের
তত্ত্বে এই লটড়াইটা আদতে বৃহত্তর শ্রেণী সংগ্রামের অংশ এবং মার্ক্সীয়
তত্ত্বানুযায়ী বিপ্লবের আবহাওয়া তৈরির চেষ্টা। এর জন্য তিনি খ্রিষ্ট মিশনারিদের
বাহবা দিয়েছেন। য়েসুদাসের পিপলস রিভোল্টএর মুখবন্ধে টি কে রবীন্দ্রন লিখলেন,
লম্পট, অধঃপতিত, সব কিছুতেই যৌনানন্দ খোঁজা সামন্ততান্ত্রিক গোঁড়া হিন্দুদের তৈরি
অভ্যেস, প্রথা এবং অধিকারের বিরুদ্ধে নাদার মহিলাদের এই বিদ্রোহ বিপ্লবাত্মক। এই
গোঁড়া হিন্দুরা কাদার তাল, দাস মানসিকতাপূর্ণ এবং সুযোগসুবিধে রহিত নিচু শ্রেণীর
ওপরে অত্যাচার করে আসছিল বহুকাল ধরে যতক্ষণনা নিচু শ্রেণী মানুষের বিবেক এবং
কৌমচেতনা জাগে নি। তারপরে এই নিচু শ্রেণীর জাতি বাতিল হয়ে যাওয়া সামাজিক এবং রাজনৈতিক
ব্যবস্থা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ত্রিভাঙ্কুরের সামাজিক নির্মান করেছে।
বক্ষাবরণী বিতর্ক
আদতে য়েসুদাস এবং রবীন্দ্রন বর্ণিত শ্রেণী বিভক্ত সমাজে উচ্চশ্রেণীর বিরুদ্ধে নিচু
শ্রেণীর ধ্রুপদী বিদ্রোহ, না হার্গ্রেভের তত্ত্বে জাতি পিরামিডের মধ্যে নাদারদের
উচ্চশ্রেণীর সম্মান পাওয়ার দরকষাকষির জিত, না মাটিয়ারের মত অনুযায়ী এটা শালীনতা আর
খ্রিষ্ট নৈতিকতার জিত, এই বিতর্কে না গিয়েই বলা যায় উপনিবেশ আর বস্ত্রের মধ্যে
দৃষ্টান্তমূলক সম্পর্ক তৈরি করতে এবং বুঝতে সাহায্য করেছে এই আন্দোলন। বস্ত্রের
চরিত্রের পরিবর্তন আদতে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের দৃষ্টিতে অনিশ্চিত পদ্ধতিতে
সামাজিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার তফাত করে দেয়। মিশনারিদের দৃষ্টিতে এই উদ্যম
আদতে বৃহত্তর ইওরোপিয় সভ্যতা বহন করে আনার প্রকল্পে আওতায় হিন্দু সমাজের মহিলাদের শালীনতা
শেখানোর উদ্যম, যে উদ্যমে তারা সভ্যতা শেখানোর পাশাপাশি তাদের ব্যবহার্য দক্ষতার
শিক্ষা দিয়েছে এবং ব্রাহ্মণ এবং নায়ারদের যৌন এবং আর্থিক অত্যাচার থেকে মুক্তি
দিয়েছে। খোলা স্তনী মহিলা পুরুষদের যৌন লালসার শিকার। এটা গুরুত্বপূর্ন যে
মিশনারিদের স্ত্রীরা কিন্তু নাদারদের মহলাদের বক্ষাবরণী কি হবে সেই আঙ্গিকটা ঠিক
করে দিয়েছিলেন।
নাদারেরা মিশনারিদের
সক্রিয় সমর্থনে এবং নতুন সামাজিক অবস্থানে, রাজ্যের প্রশাসনিক পিরামিডের উচ্চশ্রেণীর
আমলাদের আক্রমণ করল; এই বিতর্কে মিশনারিদের চেষ্টা শ্লীল বস্ত্র পরানোর চেষ্টার
উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে তাদের সব সময় নজর ছিল কিভাবে নায়ার মহিলাদের বা অন্যান্য উচ্চ
শ্রেণীর মহিলাদের মত করে বক্ষাবরণী পরার অধিকার পাওয়া যায়। এই বিতর্ক আদতে বিদেশি
শক্তির নতুন উপনিবেশের মদ তৈরি আর বিক্রি করে বেশি রাজস্ব আদায়ের অর্থনৈতিক
ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বৃহত্তর জাতি বা গোষ্ঠী দলের চরিত্র তৈরিতে সহায়ক হয়।
হারগ্রেভ বলছেন, নাদারদের একাংশ তাড়ি সংগ্রহ আর তৈরির কাজ থেকে সরে গিয়ে, তাড়ি
বিক্রি এবং তাড়ি সরবরাহের কাজ করতে শুরু করে এবং সেখান থেকে অনান্য লাভজনক ব্যবসায়
ঢুকে যায়। বিংশ শতকে মাদ্রাজে নাদারেরা তাদের ধর্ম, জাতি এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগকে
কাজে লাগিয়ে বিপুল রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে। মাটিয়ারের বক্তব্য ছিল এই বিতর্কে রাজাকে
উচ্ছেদ না করে শ্লীল এবং উচিত পরিধেয় পরার এবং সভ্যতা সরবরাহের নামে তৈরি করা এই
আন্দোলন আদতে ব্রিটিশ মিল মালিকদের বাজার হয়ে উঠতে পারে।
No comments:
Post a Comment