অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
দৈনন্দিনতার
পোষাকে ভারতীয়রা
ভারতের হিন্দু
পুরুষের পরিধেয়র মূলত তিনটে বড় অংশ একটা ধুতি – নানাভাবে ভাঁজকরে দেহের নিম্নাংশ
ঢাকার কাজে ব্যবহার হয়। দ্বিতীয়টা ঠাণ্ডা অঞ্চলে পরার জন্যে একটি সুতির শাল বা
চাদর। তৃতীয়টা মাথায় ঢাকার জন্যে দীর্ঘ পাতলা সরু কাপড়, যা পাগড়ি হিসেবে ব্যবহৃত।
সাধারণত মানুষ সুতিরই কাপড় ব্যবহার করত। কোন কোন সময় রেশমও ব্যবহৃত হত। ধুতি পরার
হাজারো পদ্ধতি আছে। এই আঙ্গিকটি কি হবে তা নির্ভর করে হয় পেশার ওপর বা আবহাওয়ার
চরিত্রের ওপর। অধিকাংশ হিন্দুর ধুতি সেলাই ছাড়া সাদা। অনেকেই কাজের জন্যে সেটিকে
মুসলমানেদের পরিধেয়র মত করে সেলাই করা পাজামা বানিয়ে নিতেন, সঙ্গে থাকত বিভিন্ন
আকারের ইওরোপিয় আঙ্গিকের জ্যাকেট, কিন্তু বাড়িতে আসার সময় তারা এই কাপড় পালটে ধুতি
পরে নিতেন।
হিন্দু আর
মুসলমান পরিধেয়র মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হল মুসলমান কাপড় কেটে সেলাই করে জোড়া পরিধেয়
পরতেন, কিন্তু হিন্দুদের কাপড় সেলাই করা হত না, সাধারণত একটিই হত। যদিও উনবিংশ
শতকে বাড়িতে বা আচার-বিহারে হিন্দুদের সেলাই করা কাপড় পরতে হত, কিন্তু কেন পুজার
সময় সেলাই না করা কাপড় পরতে হবে, আমি এই নিদানের কোন কারন খুঁজে পাই নি। আজও কিছু
গোঁড়া হিন্দু পুরুষ স্নান করার পর একটা পাটভাঙ্গা ধুতি পরার অভ্যেসটি চালিয়ে
যাচ্ছেন। এছাড়াও নানান অবশ্যমান্য আচারেবিহারে হয় রেশম বা সুতির ধুতি অবশ্য
পরিধেয়।
হিন্দুদের অসেলাই
করা ধুতি পরার বা বিশেষ ধরণের গোটা কাপড় পরার একটা কারণ, আমার ধারণা, তাদের
ব্রহ্মাণ্ড বিষয়ে সামগ্রিকতার দার্শনিক ধারণার প্রকাশ। উনবিংশ শতকে দেখেছি, পুজার
সময় পুরুষেরা একখণ্ড অসেলাই করা ধুতি পরলেও মহিলারা কিন্তু শাড়ির সঙ্গে সেলাই করা
ব্লাউজ সায়া ইত্যাদি পরছেন। তবে খাবার তৈরির আগে কিন্তু তাঁরা কাপড় পালটে বিশেষ
কাপড় পরে নেন।
নিরদ চৈধুরী
লিখছেন মুঘল দরবারে বা ব্রিটিশ দপ্তরে কাজ করা পুরুষেরা ইসলামি রীতিতে কাপড় পরতেন
কিন্তু সেটা ছিল পেশার সঙ্গে জড়িয়ে, নিজের ব্যক্তি জীবনে নয়। জনসমক্ষে যারা
মুসলমান রীতিতে কাপড় পরতে বাধ্য হতেন, তারা নিজের গৃহে বা ধর্মীয় আচারে কিন্তু সেই
পরিধেয় পরতেন না। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে কলকাতার ধনী হিন্দুদের প্রাসাদে তাদের
বাড়ির বাইরে শোয়ার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া একটি পশ্চিমি ধাঁচের কাপড় পরার ঘর থাকত।
সেখানে কত্তা ম্লেচ্ছ পোষাক ছেড়ে হিন্দু কাপড় পরে বাড়ি ঢুকতেন।
পাঞ্জাব আর
রাজস্থানে কিন্তু এই প্রথার ব্যতিক্রম দেখি। মুঘল এদেশে আসার আগেই রাজপুতেরা জামা
পরা শুরু করে দিয়েছে। যদিও আমাদের ধারণা রাজপুতেরা আকবরের সময়ে মুঘল দরবারের
প্রভাবেই তাদের পরিচ্ছদ পরিবর্তন করেছে। তবে এই সময় হিন্দু আর মুসলমানেরদের পোষাক
আলাদা করা হয়, যদিও তারা একই ধরণের জামা বা আংরাখা পরত। সেই জামার একাংশ কেটে
বুকের ওপর দিয়ে বগলের তলায় নিয়ে এসে জুড়ে দেওয়া হত। মুসলমানেরা বাঁদিকে সেলাই করা
জামা পরতেন আর হিন্দুরা ডানদিকে সেলাই করা জামা পরতেন। এই জামা হয়ত ঠাণ্ডা পরিবেশে
উত্তর ভারতে চাষী আর সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে উনবিংশ আর বিংশ শতকে শার্টের মত
পরিধেয় হয়েছে।
মুঘল শাসকের
তাদের দপ্তরে কাজ করা হিন্দুদের জন্যে আলাদা পোষাকের পরিকল্পনা করেছিল। ব্রিটিশ
আমলে যে সব হিন্দুতা করণিক, ভৃত্য, চাকর, বিচারক, রজস্ব আধিকারিক ইত্যাদির কাজ
করেছে তাদের মুঘল পোষাকেই মেনে নিয়েছে।
No comments:
Post a Comment