অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
ভারতীয় জাতীয়
কংগ্রেসের পোষাক
ভারতে পরিধেয়,
সজ্জা, আচার, উৎসব ইত্যাদির কাজে লাগা বস্ত্র শিল্পের পতনের কারণ হল দামের ফারাক
এবং মানুষের ইচ্ছের পরিবর্তন। ১৮৬০ সালে ইওরোপিয় উতপাদকেরা ভারতের মানুষের
বৈচিত্র্যপূর্ণ পছন্দ এবং পোষাকের হাজারো ব্যবহারের বিষয়েও জানতেন না। লন্ডনের অব ইন্ডিয়া অফিসের পণ্য বিষয়ক দপ্তরের দায়িত্বে থাকা প্রতিবেদক এবং ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের ডিরেক্টর জেমস(ভুল লিখেছেন ‘জন’ হবে) ফোর্বস ওয়াটসন সারা জীবন ধরে ভারতীয় বস্ত্রে্র পাঠ নিয়ে গিয়েছেন এবং ১৮টি খণ্ডে ভারতীয় বস্ত্রের একটা দীর্ঘ ও বিস্তৃতভাবে নথিকরণ করেন যার নাম দ্য টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অব ইন্ডিয়া। তিনি এটির ২০টি সেট তৈরি করে সারা ব্রিটেনে
এবং ভারতে ছড়িয়ে দেন চলন্ত মিউজিয়ামের মত করে। তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বস্ত্র
উতপাদকের পছন্দ, রুচি এবং চাহিদা বিশ্লেষণ করা। এইটা ছাড়াও তিনি আরেকটি বই লেখেন
দ্য টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারারস এন্ড দ্য কস্টিউমস অব দ্য পিপলস অব ইন্ডিয়া। এই
বইতে তিনি ব্রিটিশ উতপাদকেদের বোঝালেন ভারতের বাজারে যদি সফলভাবে কাপড় বেচতে হয়
তাহলে তাদের জানতে আর বুঝতে হবে ভারতীয় পুরুষ আর মহিলা উভয়ে কিভাবে বস্ত্র পরিধান
করে, সেই বিষয়ের সূক্ষ্ম ধারণাগুলি, তার সঙ্গে কাপড়ের আকারের সঙ্গে কি সম্পর্ক, কাপড়ের
ওপর নানান সূক্ষ্ম কাজকর্ম ইত্যাদি। তিনি লিখলেন উতপাদকেরা হয়ত রঙ, দৈর্ঘ, চওড়া
ইত্যাদি মান বজায় রেখে পাগড়ি বা লুঙ্গির কাপড় তৈরি করলেন, কিন্তু দেখা গেল তার
ওপরে যে কাজ করেছেন সেটা হয়ত সঠিক হয় নি, তাহলে গোটা কাজটা কিন্তু বরবাদ হয়ে যাবে।
তিনি বললেন
ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড় যত বেশি ভারতে বিক্রি হবে সেটা ইংলন্ড এবং ভারতের জন্যে
উপাদেয় হবে। ভারতীয়রা কম কাপড় পরে, ফলে শস্তার কাপড় তাদের পক্ষে ভাল হবে। আর এই
প্রতিযোগিতায় যদি ভারতীয় তাঁতিরা লড়াই করতে না পারে। তাহলে সেটা খুবই খারাপ হবে,
ইন আ গ্রেট প্রোডাক্টিভ কান্ট্রি লাইক ইন্ডিয়া ইজ সার্টেইন দ্যাট শি উইল গেইন; ফর সাপ্লায়ার্স
ফ্রম ব্রিটেইন সেট লেবার ফ্রি দেয়ার, ইট উইল নট বি টু ডাইভার্ট ইট এট ওয়ান্স ইন্টু
আদার এন্ড পার্হ্যাপস মোর প্রফিটেবল চ্যানেল। ইট মাইট বি আদারওয়াইজ ইফ ইন্ডিয়া
ওয়ার নট আ কান্ট্রি হুজ স্ট্রেংথ ইন র প্রোডাক্টস ইজ গ্রেট এন্ড ফার ফ্রম
ডেভেলাপড; বাট এজ ইট ইজ, হার রিসোর্সেস ইন দিস ডায়রেকশন আর নোন টু বি ক্যাপেবল অব আ
ভাস্ট এক্সপান্সান এন্ড টু বি সাফিসিয়েন্ট টু অকুপাই দ্য এনার্জিজ ফর হার ওন পিপল।
আমরা এর আগে বাংলার
ছোটলাট এবং তার প্রজাদের আবেদন নিবেদন সংক্রান্ত কথা বার্তায় বুঝেছি মানুষের ইচ্ছে
আর পছন্দের পরিবর্তন ঘটছে। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে হাজারও কেরানী যারা ভারত কলকাতা
বা বম্বের সরকারি দপ্তরে কাজ করে, তারা ভারতীয় এবং ইওরোপিয় পরিচ্ছেদ মিলিয়ে মিশিয়ে
একটা নিজস্ব কায়দায় পোষাক বানিয়ে ফেল্ল।
তারা ইস্ত্রি করা ছাড়া সাদা ইওরোপিয় শার্ট পরল, সঙ্গে সাদা ধুতি, পায়ে গার্টার
দেওয়া মোজা এবং কলকাতার চিনা দোকানের তৈরি পেটেণ্টেড চামড়ার পাম্প সু।
এস সি বোস কিছু
ধনী আর অনেকটা ইওরোপিয় ধাঁচে ফ্যাশানেবল কাপড় পরা বাঙ্গালিদের কথা লিখেছেন, যারা চাপা
প্যান্তালুন, চাপা শার্ট এবং এলপেকা বা ব্রড ক্লথের কালো কোট পরেন। তার ভাষায় এই
পষাক পরলে আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পাওয়া যাবে। এরা এর সঙ্গে মাথায় রাখে কোকুয়েটিশ
এম্বসড ক্যাপ বা কাশ্মীরি শালকে পাগড়ি করে।
ধনী কলকাতা তাদের
পরিধেয়তেই আধুনিক হতে চাইল তাই নয় নয়, বাড়ির পর্দাতেও পরিবর্তন আনল। এর আগে আমরা
দেখিয়েছি কিভাবে বাইরের শোয়ার ঘরে ম্লেচ্ছ কাপড় ছেড়ে বাড়ির কত্তা দেশিয় কাপড় পরে বাড়িতে
ঢুকতেন। বাড়ির দুই অংশে দু ধরণের গৃহসজ্জা করা থাকত।
বম্বের এক ধনী
গৃহস্থ রামচন্দ্রের ঘরের অভিজ্ঞতা লিখে গিয়েছেন কানাডিয় মহিলা এনা লিওনোউইনস।
শিক্ষিত এই গৃহকর্তা পূর্ব এবং পশ্চিমের নানা কৃষ্টি সম্বন্ধে সব জানেন কিন্তু
তিনি মনে প্রাণে আর চরিত্রে হিন্দু নন। এক সন্ধ্যায় ভারতীয় নাচ, গান আর নাটকের
আয়োজন করা হয়েছিল তার সম্মানার্থে। গৃহস্বামী উজ্জ্বল ছবির মত পরিধেয় পরেছিলেন।
গাঢ লাল রঙের সাটিনের প্যান্ট, সাদা মসলিনের আংরাখা একটি ময়ূরকণ্ঠী রঙের সোনার
জরির কাজ করা ভেস্ট এবং একটি কাশ্মীরি শাল, সাদা ইওরোপিয় মোজা এবং প্রাচীন কালের
মত করে এম্ব্রয়ডায়রি করা স্লিপার। বিনোদন শুরু হল প্রশস্ত একটা ঘরে, ময়ূরের পালক
দেওয়া কিংখাবের দেওয়াল ঝালরের প্রাচ্য আঙ্গিকে ঘরটি সাজানো। মেঝেতে চকচকে টাইল
বসানো, দেওয়াল জোড়া শেলফে ইওরোপিয় তন্বীদের পরা গয়না, কাপড়, প্রাচীন ছবি,
ভাষ্কর্য, পৃথিবীর গ্লোব আর রংবেরঙ্গের কাঁচের সজ্জা।
No comments:
Post a Comment