সমাজ বিজ্ঞান পাঠ্যের বিবর্তন
হোয়াইট স্টাডিজ আর অনুমানগুলির সমস্যার সমালোচনা
শিক্ষা সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে ভূগোল পাঠ
২০০৫ সালের পেনাঙ্গের মাল্টিভার্সিটি দ্বিতীয় সম্মিলন Redesign of Social Sciences Curriculum
শীর্ষকে উপস্থিত হয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল শিক্ষক, অনু কাপুর আহূত
শ্রোতাদের জানালেন, কেন তিনি তার স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্রদের বলেন ভূগোলের
পাঠ্যক্রমের সেই সব ভাবনাগুলি ঝালিয়ে এবং ছেঁকে নিতে, যেগুলোকে তারা সার্বজনীন
ভূগোল বলছেন, সেগুলোর মধ্যে কোন কোনটা এবং কতদূর ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার
প্রেক্ষিতে কার্যকর।
ছাত্রছাত্রীরা নতুন করে শুরু করল পাঠ্যকে ভারত আর পশ্চিমের
দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখতে, এবং তারা যখন এই বিভাগ করাটা শেষ করল, তখন দেখা গেল মোটামুটি
৪০০র আশেপাশের পাতার পাঠ্যক্রমের মধ্যে চতুর্থাংশ পশ্চিমে, পশ্চিমের লেখক এবং
পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গীতে লিখিত হয়েছে। আর যে সব মডেল পড়ানো হয়, বিশেষ করে কৃষিতে,
জমি ব্যবহারের প্যাটার্নটা মূলত ইওরোপ থেকে ধার করা। দেশিয় ভাবনাটা নেইই। ইন্ডিয়ার
রাজনৈতিক স্বাধীনতা ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও অবস্থার খুব বেশী কিছু পরিবর্তন হয় নি।
এই চরিত্রগুলো সেই ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দ্বারা তৈরি হয়েছিল
এবং আজও বহাল তবিয়তে অবস্থান করছে। নৃতাত্ত্বিকদের মতই ভূগোলবিদেরা এবং
কার্টোগ্রাফাররা অইওরোপিয় দেশগুলি দখল আর লুঠের কাজে সাম্রাজ্যকে সরাসরি সহায়তা
করেছিল। ভূগোলবিদেরা সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তারে সাহায্য করে সাম্রাজ্যের সীমা
নতুন করে নির্ধারণ করে। ভূগোলবিদেরা সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন অঞ্চল এবং
ক্ষেত্রর নাম পাল্টানোতে সহায়তা করে, এবং নিজেদের দেশের এলাকার নাম ধার করে এবং
নামগুলির খ্রিষ্টিয়করণও করে এনে উপনিবেশের শহর, এলাকা, শহরতলীর নাম পালটে দেয় যাতে
দেশ থেকে নতুন করে সাম্রাজ্যে আসা চাকরিজীবি আর ব্যবসায়ীরা দেশের কথা মনে করতে
পারে।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যের কবল থেকে বেরিয়ে আসার পরে
কিভাবে দেশগুলো তাদের এলাকার নাম পালটে ফেলছে। এটা কিন্তু দেখার। নতুন নামকরণ আরেক
ধরণের ক্ষমতা তৈরির আভাস। বম্বের নাম হোল মুম্বই এরকম প্রত্যেকেরই কিছু কিছু
উদাহরণ নিশ্চই মনে পড়বে। সমস্যা হোল এই রাজনৈতিক হাতিয়ারকে ভোট হাতানো বা রাজনৈতিক
সমর্থন জোগাড় করার জন্যে কাজে লাগানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, যারা
আমেরিকিয় রাজনৈতিক চিন্তকদের তত্ত্ব অনুসরণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান, তাদের থেকে
কোন তুল্যমূল্য উদ্যোগ দেখা যায় না।
এই রকম কড়া প্রতিবাদ সত্ত্বেও(যা কয়েক দশক ধরে হয়ে চলেছে)
স্বাধীন ইন্ডিয়ার রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত এই বিপুল অর্থবান ক্ষমতাশালী
বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও ইওরোপিয় ধারণা এবং ইওরোপিয় ভাবনাচিন্তা কোন রকম লজ্জা ছাড়াই
পড়ানো হয়। ডুর্খেইম, ওয়েবার, মার্ক্সএর তত্ত্ব ইওরোপিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ঠিক আছে।
নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে এবং অন্যদের বাজার থেকে হঠিয়ে দিতে ভোক্ত্রাদের জন্যে দূরদর্শনে
নিয়মিত কোকাকোলা বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হওয়ার মতই, আমরাও এই মানুষদের আলাপ আলোচনা
দেখে মনে করি যেহেতু ইংরেজি শিক্ষিত বাবুরা এই তত্ত্বগুলো বারবার আওড়ান এবং ইওরোপিয়
শিক্ষা ব্যবস্থা আর অন্যান্য ভাবনাগুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের নিজের রাজত্বে স্বরাট
হয়ে বসে আছে বলেই আমাদের মনে হয় এই ভাবনাগুলোর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আমরা অন্য
তাত্ত্বিকদের কথা জানি না কারণ আমরা ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ভাষাই জানি না।
আমার প্রশ্ন হল এই সমাজতাত্ত্বিক, তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিকতাত্ত্বিকদের মধ্যে
মিল কোথায়? কেন আমরা মেনে নিই না, আমরা তাদের মহত্ব স্বীকার করে নিয়েছি কারণ তাদের
নাম উঠতে বসতে নিয়মিত শুনি, প্রচার করি, ফলে প্রভাবিত হয়েই মেনে নিই। আমাদের নিজস্ব
কোন ধারণা গড়ে ওঠে না। কি করেই বা গড়ে উঠবে। এই তাত্ত্বিকেরা দুশতাব্দ আগে জার্মান
ভাষায় লিখেছিলেন তাঁদের তত্ত্ব। তারপরে সেগুলো ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে। আমাদের হয়
ইংরেজি বা জার্মান জানতে হবে সেগুলো বুঝতে। কোন লেখাই আমাদের মাতৃভাষায় লিখিত নয়।
তাহলে কেন বার বার আমরা তাদের নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি না। আমরা কি মুর্খ
হয়ে যাব? আজ সেগুলো আমরা শুধুই নকল করে চলেছি, সেই শৃঙ্খল থেকে কি আমরা মুক্ত হব
না – নাকি আমরা সেই দূর সময় বসে মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা বিশ্বকে আজও দেখতে
থাকব? তাহলে কি এটা ঠিক হল, আমরা কোন মানসিক ক্রাচ ছাড়া আর বেশি দূর হাঁটতে পারব
না।
No comments:
Post a Comment