সমাজ বিজ্ঞান পাঠ্যের বিবর্তন
ইওরোপমুখ্যতা অতিক্রম – নতুন কাঠামো এবং পদ্ধতি বিষয়ক কিছু ভাবনা
চ) আমরা যদি সমাজবিজ্ঞানকে ঠিকঠাকভাবে নামকরণ করতে পারি
তাহলে এগুলিতে স্বচ্ছতা আসবে। আমরা যদি অন্যান্য সমাজতত্ত্ব আলোচনায় সমাজতত্ত্বের ইওরোপিয়
তত্ত্ব আলোচনার সময় সেটাকে ইওরোপিয় সমাজতত্ত্ব নাম দিই বা আমেরিকিয় তাত্ত্বিকদের
কাজ পড়ার সময় আমেরিকিয় সমাজতত্ত্ব বলি তাহলে বোঝা যাবে। এটি জ্ঞানচর্চায় সমতা নিয়ে
আসবে এবং পাঠককে মনে করিয়ে দেবে অন্যান্য জাতিবাদী বিজ্ঞানের মত ইওরোপিয় বিজ্ঞান চর্চা
আদতে এথনোসায়েন্স, সেগুলো ইওরোপের জন্যে হয়ত ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের জন্যে উদ্ভট
এবং হাস্যকর।
ছ) এতদিন ধরে চলে আসা নৃতাত্ত্বিক বিভাগগুলি বন্ধ করে দেওয়া
দরকার। যেহেতু প্রচুর মানুষ এই কাজে জুতে আছেন, এটা খুব তাড়াতাড়ি করা যাবে না,
তাদের উল্টো-নৃতত্ত্বের(রিভার্স আন্থ্রোপলজি) পাঠ পড়ানো দরকার। ইয়োরোপের সমাজ সম্বন্ধে
গবেষণা করতে আমাদের অইওরোপিয় জ্ঞানী প্রয়োজন। তাদের প্রাচ্যবিদ্যার মত আমাদের হাতে
তৈরি ইওরোপবিদ্যা(Europology) দিয়ে আমরা যেভাবে ইওরোপিয়রা এবং বর্তমানে আমেরিকিয়রা সারা
বিশ্বের ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যেক সমাজ এবং পরিবেশে ঢুকে তাদের মত মাথা গলিয়ে বিশ্বকে
অবাসযোগ্য দুঃস্বপ্নে ভরপুর করে তুলেছে তার বিরুদ্ধে আমাদের কি করনীয় তার পথ দেখতে
পারব। ইওরোপবিদ্যা আমাদের বর্তমানের ইওরোপসৃষ্ট নানান অনাচার যেমন দক্ষতা আর উত্পাদনশীলতা ওপরে অসীম জোর, সমসত্ত্বতার দিকেও ঝোঁক,
অর্থনীতিকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেওয়া,
ব্যক্তিগত কৃতিত্বর ওপরে অতিনির্ভরতা, বিশ্বকে একদেহী (হোমোজিনিয়াস) করে তোলা, কৃষ্টিগত
বৈচিত্রের ন্যুনতা(flatten cultural diversity), বিভিন্ন কারখানাসম বিদ্যালয়ে একই ছাঁচের মানুষ তৈরির
উদ্যমের মত কৃষ্টিগতভাবে ঘৃণ্য এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতারক বিষয়গুলির দিকে দৃষ্টি ফেরাতে সাহায্য করবে। অইওরোপিয়রাই বিশ্লেষণের কাজ
হাতে নিলে সেটি ইওরোপিয় সমাজেরও কাজে আসবে। কিন্তু আমরা কেন এই দলদলে পা ঢুকয়ে
নিজেদের ফাঁসাব? আমাদের কৃষ্টি আর ধর্ম বলেছে যন্ত্র দিয়ে নিজেদের মাপানোর কাজ না করিয়ে
বাঁচার কি আনন্দ সেটা আমরাই জানি।
জ) বর্তমানে চলতে থাকা এবং গভীরভাবে প্রভাবশালী
ইওরো-আমেরিকয় প্রত্যক্ষ্যবাদী পদ্ধতিকে প্রশ্ন করা দরকার। প্রয়োজনে তাকে ছুঁড়ে
ফেলে দেওয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানের সৃজনশীল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা
দরকার, যেটা মানব সভ্যতা আর অন্যান্য প্রজাতির প্রাণজগতের কাজে আসবে, যেখানে
বিশ্বের বাস্ততন্ত্রকে শ্রদ্ধা করা হবে। প্রত্যেকের সঙ্গে সমভাবে আলোচনা করার
উদ্যম নেবে বিশ্ববিদ্যালয়। এতে প্রত্যক্ষ্যবাদিতা উপে যাবে না ঠিকই, বা চুঁইয়ে
পড়ার তত্ত্বর প্রভাব পুরোপুরি আটকানোও যাবে না, কিন্তু এটা শিক্ষার্থীরা মনে রাখবে
চুঁইয়ে পড়া পদ্ধতির তুলনায় সৃষ্টিশীল পন্থাই পথ, না হলে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি
হয়।
ঝ) ক্ষমতাশালী অধ্যাপকেদের লেখা পাঠ্য পুস্তক আর প্রকাশনা
সংস্থাকে খুব তাড়াতাড়ি বর্জন করা দরকার। বৌদ্ধিক পড়াশোনার শ্রেণী নিজের
পাঠ্যপুস্তক রচনা করুক, নিজেদের সমাজের জ্ঞানচর্চার পথ নির্ধারণ করুক, অবশ্যই
সমালোচনার দৃষ্টিতে, কিন্তু নিজের দৃষ্টিভঙ্গী অবলম্বন করে। ফরাসি, জার্মান বা
আমেরিকিয়রা এই কাজটি করতে পারে, তাহলে পদ্ধতিগতভাবে কেন আমরা করতে পারব না? এটা
যদি তাদের অধিকার হয়, তাহলে এটা আমাদেরও অধিকার। আমরা নিজেরা নিজেদের পাঠ্য পুস্তক
রচনা করলে, বাজারে বন্যার মত ছেয়ে যাওয়া পশ্চিমী পদ্ধতিতে লিখিত বইএর হাত থেকে
মুক্তি মিলবে।
ঞ) গবেষণার পদ্ধতিটা বক্তৃতা আর পাঠ্যপুস্তক নির্ভর না হয়ে
অনেক বেশি আলোচনা সাপেক্ষ এবং নানান ধরণের মাধ্যম নির্ভর হওয়া দরকার। আমাদের সময়
পাঠ্যপুস্তক জ্ঞানের অপকর্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়ে রয়েছে। আধুনিক সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপজাত এগুলি। আমাদের সমাজগুলি যেমন কোরাণ বা মহাভারত থেকে কোন বছরের পর বছর নানা
জ্ঞান গ্রহণ করে চলেছি, তেমনি এইগুলোকেও একইভাবে চিকিৎসা করা দরকার নেই, এগুলোকে
প্রশ্ন করা দরকার। বরং এই ধ্রুপদী পাঠ্যগুলি আমাদের শ্রেণীর মৌলিক পাঠ্য হওয়ার
দরকার, এগুলিকে নিয়ে শ্রেণীতে বিশদ আলোচনা করা দরকার।
চ) পশ্চিমি সমাজবিজ্ঞানী, পেশাদারদের আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়
এসে অবাধে গবেষণা করার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া উচিত, যদি না তারা সমাতরালভাবে তাদের
সমাজে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আমাদের গবেষকদের কাজ করার সুযোগ করে দেয়।
ছ) পশ্চিমি সমাজ ও জ্ঞানচর্চাকে সর্ব্ব্যাপী(inclusive) করে তুলতে হবে, এই ধারণা
থেকে খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসা দরকার। কারণ এতে তারা অপশ্চিমি জ্ঞানচর্চাকে তাদের
নিজেদের ঘাটতিওয়ালা জ্ঞানচর্চায় প্রবেশ করিয়ে তাদের জ্ঞানচর্চার প্রসার বাড়াবে এবং
পশ্চিমের চলতি কাঠামো আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। এতে তাদের উন্নতি হবে, তাতে আমাদের
কি, তারা তো আর আমাদের জ্ঞানচর্চার বিস্তার ঘটাবে না।
এখানে ওখানে খুটুর খাটুর করে সারাই করা পাঠ্যক্রম কোনভাবেই
আমাদের শিক্ষাকেন্দ্রিগুলির ইওরোপকেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে আসার নিদান নয়। ইওরোপকেন্দ্রিক
সমাজবিজ্ঞান এবং ইওরোপিয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা আমাদের নতুন
শুরুয়াতের রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে।
No comments:
Post a Comment