সমাজ বিজ্ঞান পাঠ্যের বিবর্তন
১৮৩৫ সালের টমাস মেকলের এবং ১৮৯২ সালের
আমেরিকার কমটি অব টেনের প্রস্তাবনা
কোন নির্দিষ্ট মানব সমাজকে নির্দিষ্ট দিকে
চোখে ঠুলি বেঁধে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অবাস্তব প্রকৃতি বিরোধী চিন্তা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার বিপক্ষে সারা জীবনধরে কাজ করেগিয়েছেন
নিজের উদ্যমে।
নিরদ চৌধুরী বা রামমোহন রায়ের মাত মানুষ
যারা সারা জীবনধরে পশ্চিমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে আত্মস্থ করার এবং পশ্চিমি শিক্ষা
ব্যবস্থাকে বিশ্বজনীন করার প্রচেষ্টার সব থেকে বড় প্রচারক ছিলেন, পশ্চিমের মাটিতেই
তাদের মৃত্যু ঘটেছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়েই। আজ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি
করে পশ্চিমি জ্ঞানচর্চা এবং তার অনুসারী চর্চাকেই প্রচার করে চলেন, তাদের চাকরির
মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পরে তাদের অনেকেরই খোলস ছেড়ে যায়। রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে তাদেরত
অনেকেই আবার নিজের শেকড়ে ফিরে আসেন।
এই মন্তব্যগুলি মোটামুটি প্রায় সব কটা
শিক্ষা উদ্যমগুলির অভিজ্ঞতা সূত্রে বলতে পারছি। আমরা এবারে সমাজবিজ্ঞানগুলিকে একে
একে আলাদা করে বিচার করার চেষ্টা করব। তার আগে আমাদের একটা বিসেষ ইস্যু আমাদের সময়ের
সমাজ বিজ্ঞানে অনুমানের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি।
হোয়াইট স্টাডিজ আর অনুমানগুলির সমস্যার
সমালোচনা
ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম নিয়ে ভারতীয় পুরাণে
একটি গল্প আছে। বিভিন্ন সমাজে এই গল্পটির নানান সংস্করণ আছে এবং সেগুলি ভিন্ন
ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এই সংস্করণগুলির মধ্যে আমার অন্যতম আকর্ষণের
কেন্দ্রবিন্দু হল সেই গল্পটি, যেখানে একজন জ্ঞানীকে প্রশ্ন করা হচ্ছে বিশ্ব কার
ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। তার উত্তর এল দাঁড়ানো একটি বাঘ তার ওপরে একটি মঞ্চ তার ওপরে ব্রহ্মাণ্ড।
প্রশ্ন উঠল বাঘ কার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে? উত্তর এল হাতি। হাতি কার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে?
উত্তর এল কচ্ছপ। এরপরে আর কাউকে কথা বলতে না দিয়ে জ্ঞানী মানুষটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
বললেন কচ্ছপটা এক্কেবারে নিচে পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
সমাজ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান বা অর্থনীতি নিয়ে
একই ধরণের প্রশ্ন করুণ – কোন ধারনাগুলির ওপর এই গোটা জ্ঞাআনচর্চা দাঁড়িয়ে আছে?
কচ্ছপের গল্পের মত প্রত্যেকটি জ্ঞানচর্চা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে একটি
ধারনাগুচ্ছের ওপর যাকে প্রশ্ন করলে কোন যথাযোগ্য উত্তর পাওয়া যায় না, কারণ সেগুলি
নির্ভর করে আরও কিছু ধারণাগোষ্ঠীর ওপর, সেগুলি নির্ভর করে আরও কিছুর... এরকম কোন
প্রশ্ন ছাড়াই ধারণার সেট, তার ওপর ধারনার সেটের ধারণার প্রচার চলতেই থাকে।
ধারণার সংজ্ঞা হিসেবে বলতে পারি, এটি একটি
প্ল্যাঙ্ক বা প্ল্যাটফর্ম, যার সত্যতার সত্যতাকে সত্যতা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, যাকে
জাগতিকভাবে নস্যাৎ করা যায় না, বা যাকে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবেও প্রতিষ্ঠা দেওয়া
যায় না। ধারণা কোন বিশ্বজনীন বিশ্বাস নয়, কিন্তু কিছু সঙ্খ্যালঘু বিদ্বানদের যেমন
এক দল বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠীর নিদান দেওয়া বিশ্বাস, তৈরি করা। অন্য ভাষায় বলতে গেলে
আমরা কেন ধারনাগুলিকে ব্যবহার করব, তার জাস্টিফিকেশনটাই বুঝতেই পারিনা, অথবা কেন
আমরা অন্য কিছু ধারনার পারফরমেন্সের ফলের ওপর নির্ভর করে আরেকটি সেটের ধারনা
চালাবার চেষ্টা করব তারও কারন বুঝতে অপারগ। পশ্চিমি দর্শনের presuppositionless philosophizingই আমাদের কাণাগলিতে ঢুকিয়ে দেয়। খুব আলগোছে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গেলে বলতে
হয়, অন্যান্য সামাজিক কাজে রোজগারের সুযোগ না পাওয়া কিছু অযোগ্য অধ্যাপককে পশ্চিমি
শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের ধারনাগুলি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ দিয়েছে।
এবার আমরা বোঝার চেষ্টা করব, নৃতত্ত্ব,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সমাজতত্ত্বের মত সমাজবিজ্ঞানের ধারাগুলি কোন ধারণার ওপরে ভর
করে দাঁড়িয়ে আছে। আজকের সব কটি সমাজ বিজ্ঞানের ধারণাগুলি নির্ভর করে ইওরোপিয় সাদা
সমাজের মানুষদের অভিজ্ঞতা এবং কৃষ্টিগত লক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে। ফলে এতাই বাসব যে
সামাজিক বা রাজনৈতিক তত্ত্ব বৃহত্তরভাবে এই সমাজ বিজ্ঞানকে কিভাবে দেখছে, তার একটা
প্রতিফলন। ফলে কেউ যদি প্রশ্ন করে কেন আমরা ইওরোপিয় সামাজ বিজ্ঞান পড়ছি, তার কোন
যুক্তিবদ্ধ বা জোরালো উত্তর কারোর কাছেই নেই, শুধু এই ভাবটা – যেহেতু সক্কলে এই শিক্ষাটা নিচ্ছে তাই
প্রত্যেকেই ভুল কাজ করতে পারে না। দশকের পর দশক ধরে প্রত্যেকেই এই কাজটি করে
চলেছেন, তাই আমরা ধরেই নিয়েছি ইওরোপিট সমাজতত্ত্ব বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশ্বজনীন, সব
সময়, এলাকা এবং মানব সমাজের সক্কলের জন্যে উপাদেয়।
No comments:
Post a Comment