বিনয় লালের মুখবন্ধ
পশ্চিমের ঔপনিবেশিক বৈজ্ঞানিকেরা যদি গেটেরে মত মানুষকেই চুপ করিয়ে দিতে পারেন এবং উপহাসের পাত্র করে তুলতে পারেন সারা বিশ্বের কাছে তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে, তাহলে দেশিয় পরম্পরার সমাজের জ্ঞানভাণ্ডারকে আধুনিক বিজ্ঞানের ধারক বাহকদের তারা যে আরও বড় উপহাসের পাত্র করে তুলবে তা তো বলাই বাহুল্য, যদিও আধুনিক পশ্চিম তার জ্ঞানচর্চায় সারাক্ষণ বহুত্ববাদ, বহুকৃষ্টিবাদের মালা জপে চলছে। কিছু কিছু সময় পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা ‘অন্যদের’ জানার চেষ্টায় সেই জ্ঞানচর্চাকে কিছুটা হলেও ছাড় দিয়ে থাকেন, তাও তাদের শর্ত মেনে। অতলান্ত সাগরের দ্বীপুঞ্জের অধিবাসিন্দারা না জানি কত কাল ধরে পশ্চিমের সমুদ্র বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছেন। আমেরিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়েরই দর্শন বিভাগেই পরম্পরার, আদিবাসীদের স্থানীয় জ্ঞানের পাঠ্যক্রম তৈরি করে নি, এই দায়িত্বটা পড়েছে নৃতত্ত্ব বিভাগের ওপরে। দর্শনের সত্য আদতে বিজ্ঞান এবং ঔষধ বিভাগেরে ক্ষেত্রেও সত্য – সে মনে করে দর্শন মানেই পাশ্চাত্য দর্শন এবং ওষুধ অর্থে পশ্চিমি এলোপ্যাথিক ওষুধ ব্যবস্থা। আমরা কেউ যখন দর্শনের মাধ্যমে অন্য একটু কিছু আলাদা করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি, তখন তৈরি হয় আফ্রিকিয় দর্শন, ভারতীয় দর্শন ইত্যাদি। পশ্চিমের সঙ্গীত বিভাগ আদতের সঠিক বিশুদ্ধ সঙ্গীত অর্থাৎ পশ্চিমের ধ্রুপদী সঙ্গীতই চর্চা করে; অন্যান্যদের সব ধরণের সঙ্গীত চর্চা এথনোমিউজিওলজিতে ঢুকে পড়েছে, যেমন করে অন্যান্যদের বিজ্ঞান, এথনোসায়েন্স হিসেবে পশ্চিমে পদবাচ্য। আজকের আমাদের কাজ হল জ্ঞানসমষ্টিরচর্চার রূপান্তরকরণ, বিশেষ করে সেই সব জ্ঞানচর্চা যেগুলোকে এত কাল প্রান্তিক করে রাখা হয়েছিল, দমিয়ে রাখা হয়েছিল, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছিল এবং তাদের সামগ্রিক কৃষ্টিগত বৌদ্ধিক চেতনার মর্যাদাকে চোখা রাঙ্গিয়ে পায়ের তলায় ফেলেরাখা হয়েছিল।
বক্ষ্যমান চটিটায়, লেখক, আন্দোলনকর্মী, দেশিয় চাষী এবং রাজনৈতিক বিপ্লবী ক্লদ আলভারেজ, যিনি নিজে মাল্টিভার্সিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বহুকাল ধরে অবিশ্রান্তভাবে পশ্চিমের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চাকে এবং তার দাসত্ব আর নকলকরার মাত্রার বিশ্বজোড়া বিদ্বানদের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, এদের জ্ঞানচর্চা শুধুই উচ্চশিক্ষার শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতেই আবদ্ধ থাকে। আলভারেজ ১৯০৯ সালের মোহনদাস গান্ধীর ছোট্টতম হিন্দ স্বরাজ বা ইন্ডিয়ান হোমরুল বইটির বিংশ পরিচ্ছেদের কিছু স্তবক উল্লেখ করে বলছেন deportation for life to the Andamans is not enough expiation for the sin of encouraging European civilisation। গান্ধী আন্দামান পছন্দ করতেন উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে, কেননা, এই অঞ্চলেই বাইরের সাহায্য ছাড়াই বহু আদবাসী বেঁচেছেন, এবং এই আন্দামানেই বিপজ্জনক স্বাধীনতাকামীদের নির্বাসন দেওয়া হত। আন্দামানে সারা জীবনের জন্যে নির্বাসিত হওয়া বিপ্লবীদের অন্য সামাজিক মৃত্যু দেখছেন না গান্ধী, ইওরোপিয়দের হাতে তৈরি সমাজ থেকে নির্বাসন দেখছেন। তিনি তার কুড়ি বছর পরে বলবেন, whatever service I have been able to render to the nation has been due entirely to the retention by me of Eastern culture to the extent that it has been possible।
গান্ধী পুরোপুরি পশ্চিমকে অস্বীকার করতে পারেন নি। আমরাও পরিষ্কার নই যে তিনি আদৌ তা চেয়েছিলেন কি না, কিন্তু তার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল স্বাধীনতা কিন্তু অবিভাজ্য। এটা স্বীকৃত যে আধুনিক পশ্চিম তার টলস্টয় বা থুরোর মত বিদ্রোহী তাত্ত্বিকদের অস্বীকার করেছে, গান্ধী তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন, যাদের তত্ত্বের মধ্যে বৃহত্তর বহুত্ববাদ, সাম্য এবং বিচারের দৃষ্টিভঙ্গী জায়মান হয়ে আছে। একটা শর্ত গান্ধী জুড়ছেন, এটা যতটাদূর সম্ভব টেনে নিয়ে যাওয়ার। তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী বিশ্লেষণ করে তিনি আরও বৌদ্ধিক স্বাধীনতা আর কৃষ্টিগত সম্মান চাইছেন, একই সঙ্গে তিনি বলছেন, এমনকি দেশজ এবং আদিবাসী জ্ঞান তার শুদ্ধ কাঠামোয় ব্যবহার করা যাবে না। যেমন আয়ুর্বেদে দেহ, রোগ এবং সেরে ওঠার দর্শন আর তত্ত্ব এলোপ্যাথির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, কিন্তু তা সত্ত্বেও আয়ুর্বেদকে আধুনিক বায়োমেডিসিনের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। উনবিংশ শতকে জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলনে আয়ুর্বেদ গর্বিত উত্তরাধিকার বহন করলেও, বৈদ্যকেরা বললেন এর পাঠ্য, জ্ঞানচর্চা, শিক্ষার পদ্ধতিকে পশ্চিমি বায়োমেডিক্যাল পদ্ধতি অনুসরণ করে ঢেলে সাজাতে হল, কারণ বাজার অর্থনীতির বাধ্যবাধকতা। যদিও খুব কঠিন কাজ, কিন্তু আলভারেজ রাজনৈতিক, নৈতিক এবং কৃষ্টিগত পছন্দের বিষয়ে পশ্চিমি জ্ঞানচর্চার একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞান চর্চা থেকে স্বাধীনতা পেতে একবগগা ভূমিকা নিয়েছেন।
পশ্চিমের ঔপনিবেশিক বৈজ্ঞানিকেরা যদি গেটেরে মত মানুষকেই চুপ করিয়ে দিতে পারেন এবং উপহাসের পাত্র করে তুলতে পারেন সারা বিশ্বের কাছে তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে, তাহলে দেশিয় পরম্পরার সমাজের জ্ঞানভাণ্ডারকে আধুনিক বিজ্ঞানের ধারক বাহকদের তারা যে আরও বড় উপহাসের পাত্র করে তুলবে তা তো বলাই বাহুল্য, যদিও আধুনিক পশ্চিম তার জ্ঞানচর্চায় সারাক্ষণ বহুত্ববাদ, বহুকৃষ্টিবাদের মালা জপে চলছে। কিছু কিছু সময় পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা ‘অন্যদের’ জানার চেষ্টায় সেই জ্ঞানচর্চাকে কিছুটা হলেও ছাড় দিয়ে থাকেন, তাও তাদের শর্ত মেনে। অতলান্ত সাগরের দ্বীপুঞ্জের অধিবাসিন্দারা না জানি কত কাল ধরে পশ্চিমের সমুদ্র বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছেন। আমেরিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়েরই দর্শন বিভাগেই পরম্পরার, আদিবাসীদের স্থানীয় জ্ঞানের পাঠ্যক্রম তৈরি করে নি, এই দায়িত্বটা পড়েছে নৃতত্ত্ব বিভাগের ওপরে। দর্শনের সত্য আদতে বিজ্ঞান এবং ঔষধ বিভাগেরে ক্ষেত্রেও সত্য – সে মনে করে দর্শন মানেই পাশ্চাত্য দর্শন এবং ওষুধ অর্থে পশ্চিমি এলোপ্যাথিক ওষুধ ব্যবস্থা। আমরা কেউ যখন দর্শনের মাধ্যমে অন্য একটু কিছু আলাদা করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি, তখন তৈরি হয় আফ্রিকিয় দর্শন, ভারতীয় দর্শন ইত্যাদি। পশ্চিমের সঙ্গীত বিভাগ আদতের সঠিক বিশুদ্ধ সঙ্গীত অর্থাৎ পশ্চিমের ধ্রুপদী সঙ্গীতই চর্চা করে; অন্যান্যদের সব ধরণের সঙ্গীত চর্চা এথনোমিউজিওলজিতে ঢুকে পড়েছে, যেমন করে অন্যান্যদের বিজ্ঞান, এথনোসায়েন্স হিসেবে পশ্চিমে পদবাচ্য। আজকের আমাদের কাজ হল জ্ঞানসমষ্টিরচর্চার রূপান্তরকরণ, বিশেষ করে সেই সব জ্ঞানচর্চা যেগুলোকে এত কাল প্রান্তিক করে রাখা হয়েছিল, দমিয়ে রাখা হয়েছিল, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছিল এবং তাদের সামগ্রিক কৃষ্টিগত বৌদ্ধিক চেতনার মর্যাদাকে চোখা রাঙ্গিয়ে পায়ের তলায় ফেলেরাখা হয়েছিল।
বক্ষ্যমান চটিটায়, লেখক, আন্দোলনকর্মী, দেশিয় চাষী এবং রাজনৈতিক বিপ্লবী ক্লদ আলভারেজ, যিনি নিজে মাল্টিভার্সিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বহুকাল ধরে অবিশ্রান্তভাবে পশ্চিমের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চাকে এবং তার দাসত্ব আর নকলকরার মাত্রার বিশ্বজোড়া বিদ্বানদের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, এদের জ্ঞানচর্চা শুধুই উচ্চশিক্ষার শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতেই আবদ্ধ থাকে। আলভারেজ ১৯০৯ সালের মোহনদাস গান্ধীর ছোট্টতম হিন্দ স্বরাজ বা ইন্ডিয়ান হোমরুল বইটির বিংশ পরিচ্ছেদের কিছু স্তবক উল্লেখ করে বলছেন deportation for life to the Andamans is not enough expiation for the sin of encouraging European civilisation। গান্ধী আন্দামান পছন্দ করতেন উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে, কেননা, এই অঞ্চলেই বাইরের সাহায্য ছাড়াই বহু আদবাসী বেঁচেছেন, এবং এই আন্দামানেই বিপজ্জনক স্বাধীনতাকামীদের নির্বাসন দেওয়া হত। আন্দামানে সারা জীবনের জন্যে নির্বাসিত হওয়া বিপ্লবীদের অন্য সামাজিক মৃত্যু দেখছেন না গান্ধী, ইওরোপিয়দের হাতে তৈরি সমাজ থেকে নির্বাসন দেখছেন। তিনি তার কুড়ি বছর পরে বলবেন, whatever service I have been able to render to the nation has been due entirely to the retention by me of Eastern culture to the extent that it has been possible।
গান্ধী পুরোপুরি পশ্চিমকে অস্বীকার করতে পারেন নি। আমরাও পরিষ্কার নই যে তিনি আদৌ তা চেয়েছিলেন কি না, কিন্তু তার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল স্বাধীনতা কিন্তু অবিভাজ্য। এটা স্বীকৃত যে আধুনিক পশ্চিম তার টলস্টয় বা থুরোর মত বিদ্রোহী তাত্ত্বিকদের অস্বীকার করেছে, গান্ধী তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন, যাদের তত্ত্বের মধ্যে বৃহত্তর বহুত্ববাদ, সাম্য এবং বিচারের দৃষ্টিভঙ্গী জায়মান হয়ে আছে। একটা শর্ত গান্ধী জুড়ছেন, এটা যতটাদূর সম্ভব টেনে নিয়ে যাওয়ার। তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী বিশ্লেষণ করে তিনি আরও বৌদ্ধিক স্বাধীনতা আর কৃষ্টিগত সম্মান চাইছেন, একই সঙ্গে তিনি বলছেন, এমনকি দেশজ এবং আদিবাসী জ্ঞান তার শুদ্ধ কাঠামোয় ব্যবহার করা যাবে না। যেমন আয়ুর্বেদে দেহ, রোগ এবং সেরে ওঠার দর্শন আর তত্ত্ব এলোপ্যাথির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, কিন্তু তা সত্ত্বেও আয়ুর্বেদকে আধুনিক বায়োমেডিসিনের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। উনবিংশ শতকে জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলনে আয়ুর্বেদ গর্বিত উত্তরাধিকার বহন করলেও, বৈদ্যকেরা বললেন এর পাঠ্য, জ্ঞানচর্চা, শিক্ষার পদ্ধতিকে পশ্চিমি বায়োমেডিক্যাল পদ্ধতি অনুসরণ করে ঢেলে সাজাতে হল, কারণ বাজার অর্থনীতির বাধ্যবাধকতা। যদিও খুব কঠিন কাজ, কিন্তু আলভারেজ রাজনৈতিক, নৈতিক এবং কৃষ্টিগত পছন্দের বিষয়ে পশ্চিমি জ্ঞানচর্চার একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞান চর্চা থেকে স্বাধীনতা পেতে একবগগা ভূমিকা নিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment