সমাজ বিজ্ঞান পাঠ্যের বিবর্তন
১৮৩৫ সালের টমাস মেকলের এবং ১৮৯২ সালের
আমেরিকার কমটি অব টেনের প্রস্তাবনা
পশ্চিমি
বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনেই একমাত্র ভবিষ্যতের জ্ঞানচর্চার চাকা(এবং মানব
উন্নয়নেরও) ঘোরতে পারে, দুর্ভাগ্যক্রমে দু’ধরণের মানুষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, প্রথমত
ইওরোপিয়রা(স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিজেদের স্বার্থ পূরণে); তার ফলে উপনিবেশের
ইওরোপিয় পদ্ধতিতে মানুষজন, বিশেষ করে শিক্ষিত বিদ্বানেরা। দু’জনেই দুজনের ভুল
কারণে।
এসেসমেন্ট
এবং ইভালুয়েশন করার মৌলিক নীতি হল বস্তনিষ্ঠতা এবং নিরপেক্ষতার জন্য তৃতীয় কাউকে
দিয়ে সমীক্ষার কাজটা করানো দরকার। কোন ব্যক্তি বা সংগঠন নিজের কাজ নিজে মূল্যায়ণ
করতে পারে না। কিন্তু আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে কি দেখলাম? পশ্চিমের সব কিছুর
যেমন পশ্চিমি বিজ্ঞানের অগ্রগতিই হোক বা পশ্চিমি ইতিহাসের গতিময়তা এবং এচিভমেন্ট
হিসেবে বুদ্ধিজীবিরা যেগুলোকে চিহ্নিত করছেন, সেগুলির এসেসমেন্ট এবং ইভালুয়েশন
করলেন পশ্চিমি বিদ্বান, ঐতিহাসিক এবং লেখকেরা। নির্লজ্জভাবে তারা নিজেদের মূল্যায়ন
নিজেরাই করলেন, তারা নিজেরাই নিজেদের ঐতিহাসিক হলেন, তারা নিজের মহত্বের মুকুট
নিজেরাই নিজেদের মাথায় পরে নিলেন, এটা নিজেদের জীবনধারনের একমেবদ্বিতীয়ম পদ্ধতিকে নিজেরাই
বাহবা দিয়ে ভরিয়ে তুললেন। এবং আরও অসীম ঔদ্ধত্য হল সাম্প্রতিককালে তারা উচ্চকণ্ঠ
ঘোষণা করে দিলেন, পশ্চিমই ইতিহাসের মৃত্যু ঘটিয়েছে, বিবর্তনের পূর্ণচ্ছেদ ঘটয়েছে
এবং এর পরে বিপুল প্রগতির বিকাশ ছাড়া আর কোন মানব প্রগতির স্তর থাকতে পারে না।
আমরা
পশ্চিমি সাম্রাজ্যের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন, গত দুশ বছর ধরে এই ধরণের
আবোলতাবোল বচন পড়ে আর শুনে চলেছি ক্রমাগত।
বস্তুতান্ত্রিকতার
অভাব এমন এক অলীক উচ্চতায় পৌঁছল যে মানব জীবনের নানান কর্ম, নন্দনতত্ত্ব, বিজ্ঞান,
প্রযুক্তি, শিল্পকলা ইত্যাদি শুধুই পশ্চিমি লেখকেরাই লিখতে শুরু করলেন এবং ইওরোপের
বাইরেও যে বিদ্বান আছে, সেটাও তাদের নজরে এল না। ইওরোপের সীমান্তের বাইরে বিদ্বান
জ্ঞানীদের ভূমিকা এবং জ্ঞানচর্চায় তাদের অবদান সম্বন্ধে এক্কেবারে অজ্ঞ কারণ তাদের
সঙ্কীর্ণ এবং ক্যাপোকিয়াল দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যে। অন্যদের জ্ঞানচর্চাগত অবদানের
স্বীকৃতি দেওয়ার অভাবের আরও একটা কারণ হল তারা মনে করে তাদের প্রকৃতিদত্ত কৃষ্টিগত
সুপিরিয়রিটির জন্যে ইওরোপ মানব প্রগতির সিঁড়ির চরমতম ধাপে পৌঁছে গিয়েছে।
পশ্চিমের
বিশ্ববিদ্যালয়ি জ্ঞানচর্চা নির্ভর সমাজ বিজ্ঞান অন্যান্য ক্ষেত্রের জ্ঞানচর্চার আঙ্গিকের
তুলনায় অনড়, উচ্চতম, অব্যর্থ। তাদের শব্দেই গোটা সমাজ বিজ্ঞানের জ্ঞানচর্চাগত
পঠনপাঠনকেই উচ্চতমতার স্বীকৃতি তারাই দিয়েছে, তাদের ক্ষমতা নির্ভর করে দিয়েছে, এটা
ভাবতে সাহায্য করিয়ে দিয়েছে যে এই ভাবেই নাকি জ্ঞানের বিকাশ ঘটে।
প্রাচ্যবাদী
বিতর্কের সাফল্য এখানেই – ভারতের, আরবের এবং অন্যান্য দেশের ইংরেজিতে শিক্ষিত জনগণ
বিশ্বাস করে বসেছে, তাদের ইতিহাস, তাদের সমাজ, তাদের পরম্পরা যোগ্যভাবে ব্যখ্যা
করতে পারে, তাদের নিজেদের সমাজের বিদ্বান নয়, একমাত্র পশ্চিমের সাদা চামড়ার বিদ্বান।
এই
সামগ্রিক মানসিক আত্মসমর্পণ এবং আত্মনিবেদনের ফলে পীড়িত হয়ে, বহু দশক আগে বিদ্বান,
জ্ঞানী, মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য Seyyed
Hussein Alatas, যেখানে তিনি, তাদের নিজেদের সমাজ সম্বন্ধে
ইওরোপ থেকে আমদানি করা তত্ত্ব তথ্যের প্রতি তৃতীয় বিশ্বের বিদ্বান বুদ্ধিজীবিদের হ্যাংলামি
দেখে লিখেছিলেন ক্যাপটিভ মাইন্ডের কথা, বলেছিলেন দেশের মাটির সঙ্গে তাদের জীবন আর
সমাজের এবং তাদের নিজের বাস্তবতার অভিজ্ঞতার বিন্দুমাত্র কোন সাযুজ্য নেই।
Ngugi wa Thiong তাঁর
Decolonising the Mind বইতে লিখছেন অবদমনের জিত ঘটে তখনই, যখন অবদমিত উপনিবেশের
কর্তকর্মের উচ্চগ্রামে গুণ গাইতে থাকে।
No comments:
Post a Comment