বিনয় লালের মুখবন্ধ
সীমান্ত পেরিয়ে কত পরিমান পণ্য বিভিন্ন দেশে গেল এল এই প্রশ্নটাকে আপাতত সরিয়ে
রেখে বিশ্বায়ন সংক্রান্ত ডামাডোল আরও সব হাজারো প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, সেগুলির
কয়েকটা নিয়ে আলোচনা করি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম বিপুল পরিমানে পণ্য
সীমান্তজুড়ে অবাধে পেরোলেও শ্রমের অবাধ চলাচলের ক্ষেত্রে বিপুল বাধা তৈরি করে রাখা
হয়েছে। কেন? বার্লিনের দেওয়াল মানুষ ভেঙ্গে ফেললেও বাংলাদেশ ভারত, গাজা এবং
ইস্রায়েল, আমেরিকা আর তার মেক্সিকোর মত দক্ষিণের দেশগুলির মধ্যে নিরেট সীমান্ত
তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে। কেন? কেন অভিবাসন আমলারা সারাবিশ্বের অচেনা অজানা শ্রমিকদের
অবাধ গতায়াত নিষিদ্ধ ঘোষনা করছে? কেউ কেউ হয়ত তুলবেন জঙ্গি আক্রমনের হুমকির
প্রশ্ন। আজ জঙ্গিবাদ রোখার নামে ৯/১১র অনেক আগে থেকেই রাষ্ট্র প্রণোদিত জঙ্গিপনা
সারা বিশ্বজুড়ে চলছে – কেননা এই জঙ্গিবাদের শিকার কোন লিবিয় নয়, সোমালিয় নয়,
পাকিস্তানি নয়, ভারতীয় নয়, নিকারাগুয়ান নয়, যেন শুধুই আমেরিকয়রা। ফলে জঙ্গি দমনে যুক্তির
ধারধারেণা বৃহৎ শক্তিগুলো। আজ জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে কড়া নজরদারিতে চলা সীমান্ত নিয়ে
প্রশ্ন ওঠে, এর আগে সীমান্তে কি ছিল? সারা বিশ্ব জুড়ে কি অসাম্য বেড়েই চলবে? আউটসোর্সিং
যদি বিশ্বায়নের কর্মকাণ্ডের তাতক্ষণিক উদর্পূর্তির উদাহরণ হয়, তাহলে কি বলতে পারি
না, ধনী দেশগুলি সীমান্তে শ্রমিকের ভিড় বাঁচিয়ে শস্তার শ্রমে উদ্বৃত্ত তৈরির ফায়দা
তুলছে? উনবিংশ শতকের চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিকের ছবি আমরা একুশ শতকের সাইবার-কুলিদের
মধ্যে দেখি না? আমাদের সময়ের হরমিন্দর বা সতীন্দ্ররা হরি আর স্যামের মুখোশে
উন্নতিশীল দেশের নব্য সুযোগবাদী হয়ে উঠছে না কি তারা উন্নতদেশের জন্যে জীবনপাত করা
প্রায় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের কাজ করছে এই প্রশ্ন তোলা যাবে না? মনে রাখা দরকার আজও
শ্রমের বাজার উন্নতদেশগুলির হাতে বিপজ্জনকভাবে নিয়ন্ত্রিত।
বিশ্বায়নের শাখাপ্রশাখাগুলি বুঝতে আমাদের চলে যেতে হবে আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের
সেই পর্বে যখন উপনিবেশবাদ নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করত। বিশ্বের বিপুল অংশ তখন
হাতেগোনা কয়েকটা লুঠেরা জাতিবাদী রাষ্টের লৌহ মুঠিতে বদ্ধ ছিল, যাদের কাছে কোন
নীতিকথার কোন মূল্যই ছিল না। পাঁচশ বছর আগে যারা বিশ্বে যে সব অভিযান এবং নৌযাত্রা
বেরিয়েছিল তার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী ২০০-৩০০ বছর ধরে আমেরিকা, দক্ষিণ, দক্ষিণ পূর্ব
এশিয়া, নিকট পূর্ব, পলিনেশিয়া, আফ্রিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে লুঠেরা খুনি
উপনিবেশ তৈরি করে। ঐতিহাসিকেরা বাগিচা উপনিবেশ, বসতি উপনিবেশ এবং অনান্য উপনিবেশের
মধ্যে পার্থক্য টেনেছেন কিছুটা সরাসরি আর পরোক্ষ প্রশাসন চালানোর প্রক্রিয়ায়। গোটা
আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় পরম্পরার সমাজকে ধ্বংস এবং নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল। বুয়ারদের
নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদা আর কালোদের মধ্যে বিপুল বৈষম্য চালিয়ে কালোদের
চরমভাবে দাবিয়ে রাখা হল। কঙ্গোতে ঠিক সেইভাবে ইওরোপিয়রা সেদেশের মানুষদের ওপর ব্যাপক
অত্যাচার ধ্বংসলীলা চালিয়ে ইওরোপিয়দের মালিকানায় রাবার বাগিচা উপনিবেশ তৈরি করল।
ভারতে ব্রিটিশদের ইতিহাস শুরু হল ব্যাপক মন্বন্তর (গণহত্যা)এর মধ্যে দিয়ে যেখানে
ক্লাইভের দখলের প্রায় এক দশকের মধ্যে ১ কোটি মানুষ মারা যাবে না খেতে পেয়ে। সঙ্গে
সঙ্গে ব্রিটিশ আমলারা ভারত ছাড়ার সময়ে বিপুল সম্পদ চুষে দেশে নিয়ে যাবে। আর তার
দেড়শ বছর পর ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় তারা ৩০ লক্ষ বাঙ্গালিকে খুনের উপহার দিয়ে যায়,
যাতে সারা বিশ্বকে বাঁচাতে যে সেনারা লড়ছিল তাদের মুখে খাওয়ার তুলে দিতে পারে। এই
ইতিহাস অসীমভাবে লিখে যাওয়া যায় না থেমে। এখানেই দাঁড়ি টানলাম।
যে সব বৈদ্ধিক লব্জর মধ্যে লুকিয়ে মুখ ঢেকে উপনিবেশবাদ আজও টিকে আছে নানা আলাপ
আলোচনায় তাদের মধ্যে দুটি হল, ভাল উপনিবেশ এবং খারাপ উপনিবেশ। যে সব সাম্রাজ্যবাদী
ব্রিটিশ(এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যপন্থী) ঐতিহাসিক কেম্ব্রিজ, হার্ভার্ড কেন্দ্রগুলির
অধ্যাপনার আসন অলঙ্কৃত করে বসে আছেন, তারা আজও অসীম উৎসাহে সেই বস্তাপচা সাম্রাজ্য
ইতিহাস চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের তারা বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ছেন, ব্রিটিশেরা
অসাধারন ভালমানুষ – তার হয়ত এখানে ওখানে এদিক সেদিক কিছু দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, কিন্তু
যারা বিশ্বকে ক্রিকেটের মত ভদ্রলকিয় খেলা উপহার দিতে পারে, তাদের প্রতিনিধিরা কখোনোই
গণহত্যাকারী বা পাইকারিহারে হত্যা করতে পারে না। ২০০৫ সালে পূর্ব আফ্রিকায়
রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে ব্রিটেনের চ্যান্সেলর গর্ডন ব্রাউন খুব সরলভাবে বললেন,
আফ্রিকা ভ্রমন করতে এসে আমি বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি উপনিবেশের ইতিহাসের
জন্যে ব্রিটিশদের কৈফিয়ত দেওয়ার দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। অতীতের কর্মকাণ্ডের জন্যে
আমাদের আত্মসমালোচনা না করে গর্বিত হতে হবে(ডেলি মেল ১৫ জানু, ২০০৫)। উপনিবেশের জন্যে
ক্ষমা চাওয়া এখন অতীত কর্ম, ব্রিটেন বিশ্ব শক্তি হিসেবে আজ আর অনুশোচনা করতে চাইছে
না। শালীনতা কোনদিনই উপনিবেশের পরিচ্ছদ ছিল না, ব্রাউন শুধু যে তার অতীতের জন্যে অশ্লীলভাবে
একাই মুখরিত হচ্ছে, তা নয়, এই কথা বলার এক মাসের মধ্যেই ২০০৫এর ২৩ ফেব্রুয়ারির
আইনে ফ্রান্সের শিক্ষকদের আইন করে বলে দেওয়া হল, বিদেশে উপনিবেশের জন্যে বিশেষ করে
উত্তর আফ্রিকায় দেশ যে সব সদর্থক কাজ করেছে, তা শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে।
ফ্রান্সে যদি কেউ আজ আরব বিশ্বে এবং মাঘ্রেবে আন্দোলনের জন্যে সাম্য আর স্বাধীনতার
গান গায় তাহলে অবাক হওয়ার কারণ নেই। ব্যক্তিস্বাধীনতা নতুন উচ্চতায় উঠে – ইতিহাসের
মৃত্যু ঘোষণা করছে। আজ স্বাধীনতা মানে ম্যাকডোয়েল অথবা বার্গার কিং, কোক অথবা
পেপসিকে নির্বাচনের স্বাধীনতা। মুক্ত বিশ্বে স্বাধীনতা আদতে ফাঁকা কলসির আওয়াজ।
No comments:
Post a Comment