৩.১ এশিয়া ব্যবসায় কোম্পানিগুলির
অংশিদার
শুরুর দিকে ডাচ
আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উভয়েই ইস্টিন্ডিজের তথাকথিত মশলা দ্বীপপুঞ্জগুলো থেকে
বিশেষ করে ইন্দোনেশিয় উপদ্বীপগুলি থেকে শুধুই মশলা নিয়ে ব্যবসার পরিকল্পনা
ফেঁদেছিল। নতুন বিশ্ব থেকে লুঠ করে আনা রূপো দিয়ে এই দ্বীপগুলি থেকে মশলা কিনতে
গ্যাল ইওরোপিয় কোম্পানিরা। তারা অবাক হয়ে দেখল, মশলা কিনতে রুপো নয় চাই শস্তার
ভারতীয় কাপড় যার নাম ক্যালিকো – এর এই এলাকায় প্রচুর চাহিদা। তারা ভারতের দিকে মুখ
ফেরাল শস্তা মোটা রুক্ষ্ম সুতির কাপড় কেনার জন্যে যার বিনিময়ে তারা ইন্দোনেশিয়
দ্বীপপুঞ্জ থেকে মশলা কিনতে পারে। তখনও তারা বাংলার দিকে মুখ ফেরায় নি। তারা
করমণ্ডল উপকূল থেকে চাহিদামত মোটা সুতির কাপড় নিয়ে মশলা দ্বীপপুঞ্জে বিনিময় করল
মশলার সঙ্গে। কিন্তু ইতিমধ্যেই করমণ্ডল এলাকার পণ্য দামি হয়ে উঠল মন্বন্তর, যুদ্ধ
বিগ্রহ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় এই অঞ্চল অনিশ্চিত হয়ে উঠলে ইওরোপিয়রা বুঝল বাংলায়
ব্যবসা করলে অনেকগুলি সুবিধে পাওয়া যায়। বাংলা শুধু বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শস্তার সব
থেকে বেশি সুতি বস্ত্র উৎপাদন করে না, তার সঙ্গে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠগুণমানের
রেশমের সঙ্গে প্রায় পাল্লা দিতে পারে এমন রেশমের উতপাদনের স্থান মিলল। ক্রমশ
ইতালিয় আর ফারসি রেশম বিশ্ব বাজার থেকে হঠিয়ে দিল বাংলার রেশম। তৃতীয় পণ্যটি ছিল
সোরা, যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত এবং সাম্রাজ্য বাড়ানোর কাজে বারুদ তৈরিতে
অতিপ্রয়োজনীয় একটি উপাদান। এছাড়াও ইওরোপে যে জাহাজগুলি যেত তাদের খোলটা ভারি করতে
সোরা ব্যবহার করা হত(S.
Chaudhuri, Trade and Commercial Organization, pp. 11-16.)।
এই প্রেক্ষিতে নজরে নিয়েই ডাচ আর ব্রিটিশেরা ১৬৫০এর দশকে বাংলায়
তাদের কুঠি স্থাপন করে। আশ্চর্যের নয়, দুটোই হুগলিতেই, সে সময়ের বাংলার সব থেকে
গুরুত্বপূর্ণতম বন্দর। তবে মধ্য সত্তর দশক থেকে বাংলার থেকে দুটি কোম্পানিরই এশিয়
ব্যবসা শৃঙ্গের দিকে উঠতে শুরু করবে। ১৬৭০এর দশকে বাংলার রেশম রপ্তানিতে বিপুল
জোয়ার আসে। এই ব্যবসা আশির দশকে আরও বড় হয়ে ওঠে ইওরোপের বাজারে বাজারে এর গুণমান
পরীক্ষিত হওয়ায়। এই আশির দশক থেকেই ইওরোপিয় কোম্পানিরা বাংলার পণ্য নিয়ে তাদের
এশিয় ব্যবসায় বিপ্লব ঘটিয়ে দ্যায়। তারপর থেকে বাংলা হয়ে ওঠে এশিয়া থেকে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির
সব থেকে বড় অংশিদার, এই ইওরোপিয় ব্যবসা করত ডাচ আর ব্রিটিশ কোম্পানিই। তাই ১৬৮০
থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত ইওরোপিয়দের মধ্যে এই দুটি ইওরোপিয়
কোম্পানিই বাংলার আন্তর্জাতিক সমুদ্রবাণিজ্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণতম ভূমিকা পালন
করে(Om
Prakash, Dutch Company, p. 8 Kristof Glamann, Dutch
Asiatic Trade, R· 144)।
আজ এটা মনে রাখা
দরকার ইওরোপি কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এশিয় ব্যবসা হিসেবে যে মশলা ব্যবসা শুরু
হয়েছিল ইন্দোনেশিয় দ্বীপুঞ্জের মশলা ইওরোপে বিক্রির দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের
মাধ্যমে, পরের কয়েক দশকে তার চরিত্র সম্পূর্ণ বদলে গ্যাল। শুরুর দ্বিপাক্ষিক
বাণিজ্য চরিত্র বদলে গিয়ে হয়ে গ্যাল ত্রিপাক্ষিক চরিত্রে – ইওরোপ, ভারতীয়
উপমহাদেশ(শস্তার মোটা কাপড়) এবং মশলা দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে(যেখানে ভারতীয় বস্ত্র
বিনিময় করা হত মশলার সঙ্গে এবং সেই মশলা উচ্চদামে বিক্রি করা হত ইওরোপে)। শেষ
পর্যন্ত এই ব্যবসা আবার দ্বিপাক্ষিক চরিত্রে ফিরে আসে – মূলত ইওরোপ আর বাংলার
সঙ্গে ব্যবসার মাধ্যমে - ১৬৮০র পররে এই পার্থক্যটা চোখে পড়তে থাকে। বাংলা হয়ে ওঠে
ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির এশিয় বাণিজ্যের মূল অংশিদার। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে ডাচ
কোম্পানির এশিয় পণ্যমূল্যের ৪০% পণ্য যেত বাংলা থেকে। ডাচেরা যে সামগ্রিক বস্ত্র
বিক্রি করত তার ৫০%এরও বেশি অংশিদার ছিল বাংলা। অষ্টাদশ শতের শুরুতে ডাচ কোম্পানির
শুধু উপমহাদেশিয় বাণিজ্য মানচিত্রেই নয় গোটা এশিয় বাণিজ্য মানচিত্রে বাংলা ছিল
গুরুত্বপূর্ণতম এলাকা। একই কথা বলা যায় ব্রিটিশ কোম্পানির ক্ষেত্রেও। বাংলার
ব্যবসাকে কোম্পানির খাতাপত্রে উল্লিখিত করা হয়েছে best flower of the.Company's garden বা the choicest jewel হিসেবে।
সপ্তদশ শতকের শেষে একজন ভব্রিটিশ কুঠিয়াল লিখেছিলেন, Bengal is the most
considerable to the English nation of all their
settlements in India'। ডাচ আর ব্রিটিশ বাংলার সব থেকে বড় সমুদ্র বাণিজ্য অংশিদার ছিল ইওরোপিয়
কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রে অষ্টাদস শতকের শুরুতে। এ মনোভাব আমরা পাই অস্টেন্ড
কোম্পানির প্রধ্যান কুঠিয়াল আলেকজান্ডার হিউমের ১৭৩০ সালের লেখায় the English and
Dutch ... are the greatest traders
in this country (Alexander Hume's
'Memoir', Stadsarchief Antwerp, General Indische Compagnie,
5769)।
No comments:
Post a Comment