সাধারণত বাংলায় ব্যবসা করা ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি রপ্তানি পণ্য জোগাড়ের জন্যে বেশ কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হত, যে সব ব্যবসায়ী বিপুল পরিমান পণ্য কেনাবেচা করতে পারেন একলপ্তে। বাংলার ব্যবসায়িক জগতে উমিচাঁদ বা খ্বাজা ওয়াজিদ এবং সবার ওপরে জগতশেঠের ব্যবসা বিশ্ব, যা আমরা এর আগে আলোচনা করেছি, তাদের সঙ্গে আর্মেনিয় Hovhahnesদের সঙ্গে ঠিক তুলনীয় না হলেও তারা অবশ্যই মেদিচি বা ফুগার বা ট্রিপ পরিবারের সঙ্গে তুলনীয় তো বটেই। এর আগে আমরা দেখেছি এদের বিশাল ব্যবসা ব্যপ্তির পরিমান কি ছিল এবং বাংলায় তারা নানান ধরণের পণ্যক্ষেত্র কিভাবে একচেটিয়া কুক্ষিগত করে রেখেছিল। এই রাজ্যে জগতশেঠ ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি। এটা পরিষ্কার যে জগতশেঠ, উমিচাঁদ বা খ্বাজা ওয়াজিদদের নেতৃত্বে যে ব্যবসা পরিমন্ডল তৈরি হয়েছিল বাংলায় সেটি ফুগার বা ক্রানফিল্ডের পরিবারদের ব্যবসার মত বিস্তৃত দক্ষ সাংগঠনিক ব্যবসার জন্যে তৈরি ছিল। ফলে আমরা এই উদাহরণ থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি, এশিয় ব্যবসা উদ্যমীদের কাঠামোর মধ্যে ছিল হকার বা পথ ব্যবসায়ী যেমন, তেমনি বড় ব্যবসায়ীরাও – যদিও তারা ব্যবসায়িক কাঠামোয় personal business-formএর জয়েন্ট স্টক কোম্পানির চাইতে অনেক বেশি তুলনীয় ছিল ভেনিসিয় ফ্রাতির্নার সঙ্গে।
এশিয় ব্যবসা ক্ষেত্রে বাংলার বড় ব্যবসায়ী পরিবারগুলি অধিকাংশ ছিল ভ্যান লাতুরের ভাষায় ছিল political animal। তার বক্তব্য এই অভিজাত ব্যবসায়ীরা ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে গাঁটছড়া বেঁধে রাজনৈতিক ব্যবসায় অংশ নিত বাংলার অভিজ্ঞ এশিয় ব্যবসায়িদের সহায়তায়। তিনি লিখছেন, ... the wealthy merchant class was allied to the mighty who exercises social and political authority(J.G. van Leur, Indonesian Trade and Society, p. 204)। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে জগতশেঠ, উমিচাঁদ আর খ্বাজা ওয়াজিদের ব্যবসা পদ্ধতির কাঠামোর মিল খুঁজে পাই। আমরা এর আগের আলোচনার দেখেছি কিভাবে বড় ব্যবসায়ীরা সম্পদ ব্যবহার করে দরবারি ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষণা অর্জন করত। আমরা এটাও দেখেছি, জগতশেঠের অতুল সম্পদ অর্জন আর ক্ষমতাকে প্রভাবিত করার সুযোগ এসেছিল দরবারি পৃষ্ঠপোষনার ফলেই। ক্ষমতার অভয় হস্তর আশ্বাস জগতশেঠেদের মত ব্যবসায়ীদের ব্যবসার কাজে এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, যে মুহূর্তে পলাশীর চক্রান্তের পরে ক্ষমতার কাঁটা বেড়া তাদের পাস থেকে সরে গ্যাল, সেই মুহূর্তে তাদের ব্যবসা জগত তাসের ঘরের মত দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে ভূমিশয্যা ধরল। একই ঘটনার প্রতিফলন দেখি উমিচাঁদ আর খ্বজা ওয়াজিদের ক্ষেত্রেও। বাংলার ব্যবসা জগতে আমাদের আলোচ্য শতকের চার আর পাঁচের দশকে এই মানুষ তিনজন এত গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছিল কারণ তাদের সঙ্গে ছিল বাংলার নবাবি দরবারের অভয় হস্ত।
বাংলার বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শাসকদের ঘনিষ্ঠ যে সম্পর্ক আমরা আবিষ্কার করলাম, যার বলে তারা রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল, ঠিক তার বিপরীত ঘটনা দেখি ষোড়শ শতকের গুজরাটের এবং অষ্টাদশ শতকের সুরাটে একটি সাম্প্রতিক গবেষণা সূত্রে(M.N.Pearson, Merchants and Rulers: Ashin Das Gupta, Indian Metchants)। গবেষক দুজনেই, দুই ব্যবসায়ীকে স্বতন্ত্র একক হিসেবে ধরেছিলেন, যাদের ক্ষমতাধরদের সঙ্গে খুব বেশি দহরম মহরম ছিল না। কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতাধরেরা ব্যবসায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। রাষ্ট্র ব্যবসায়ীদের ভালমন্দ দ্যাখাশোনা করত এবং তার বিপরীতে তারা রাষ্ট্রের কাছে নানান ধরণের অভাব অভিযোগ জানাত সরাসরি এবং এই ব্যাপারটা ১৭৪৮-৪৯এর ঘটনায় চাক্ষুষ দেখতে পাই। হুগলী ব্যবসায়ীদের জেড্ডা আর বসরা থেকে দুটি আর্মেনিয় জাহাজ ১৭৪৮ সালে ব্রিটিশরা আটক করে। হুগলী ব্যবসায়ীদের একটি দৌত্য দল এ ব্যাপারে নবাব আলিবর্দি খানের কাছে অভিযোগ জানায় এবং আলিবর্দি কোম্পানিকে চিঠি লিখে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দ্যান এবং লেখেন, The Syeds, Mogulls, Armenians and merchants of Hooghly have complained .... These merchants are the Kingdom's benefactors. Their imports and exports are an advantage to all men and their complaints are so grievous that I cannot forebear any longer giving ear to them (BPC, vol. 22, f .. 96, Annex. to Consult., 9 Jan. 1149)। ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক ক্ষমতার হাত এত দূর বিস্তৃত ছিল যে তারা কলকাতা কাউন্সিলকে লিখে জানাল, The skirts of the government are in our hands and we will not cease seeking their justice until we have full satisfaction. (Ibid., vol. 22, ff. 134vo-135, Annex. to Consult., 20 Feb. 1749)।
No comments:
Post a Comment