বাংলার
ব্যবসায়ীদের একটা সাধারণ প্রথা ছিল যে তারা যেমন নিজেদের নামে ব্যবসা করতেন তেমনি
তারা তাদের বিভিন্ন ধরণের আত্মীয় এমনকি ছেলেমেয়েদের নামেও, দেখাগ্যাছে নাবালকেদের
নাম নিয়েও ব্যবসা করতেন। তারা এক কাজটা করতেন অনেক সময় মালিকের নিজেদের পরিচয়
লুকোতে, এবং এর ফলে রাজনৈতিক বিপক্ষকে কিছুটা হলেও যাতে ধোঁকা দেওয়া যায়। ব্রিটিশ
কোম্পানি আমলারা কোন এক মধ্যস্থের দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলা এক তদন্তে ১৭৩১ সালে
দেখে বিষ্ণুদাস শেঠ এবং তার অংশিদার উমিচাঁদ কোম্পানির বরাত দেওয়া দাদনি পণ্য যেমন
নিজেদের নামেও সরবরাহ করত তেমনি তাদের সন্তানদের নামে আর কিছু কল্পিত নামেও সরবরাহ
করত(BPC,
vql. 8, ff. 424-424vo, 26 July 1731.)। এই ধরণের প্রথা খুব ব্যতিক্রমী ছিল না। ১৭৬০ সালের
প্রথমের দিকের একটি ডাচ সমীক্ষার এক উদাহরণে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা এই ধরণের
রণনীতি অবলম্বন করত হামেশাই। ডাচেদের ঢাকা কুঠি সন্তোষ রায় নামে এক বণিককে দাদন
দেয়, যার আসল নাম ছিল রঘুনাথ মিত্র যিনি ডাচেদের বস্ত্র সরবরাহ করে আসছিলেন বহুকাল।
১৭৬২ সালে তিনি নিজের নামে নয়, ডাচ কোম্পানির জন্যে বস্ত্র জোগাড় করেন তার পুত্র
আনন্দময় মিত্রের নামে(Louis
Taillefert's 'Memorie', HR 246, ff. 93-95, 17 Nov. 1763)। এছাড়াও যেসব
ব্যবসায়ী সময়মত কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির নানান তফশিল পূর্ণ করতে পারছেন,
তাদের পাশে অপর ব্যবসায়িরা দুর্গতির দিনে দাঁড়াতেন। উদাহরণস্বরূপ ১৭৫০ সালে
উমিচাঁদ তার নিজের বরাদ্দ বাদে কোম্পানিকে আরও ৩০ হাজার টাকার বস্ত্র সরবরাহ
করেছিলেন, যে বস্ত্র চুক্তি অনুযায়ী পিতাম্বর শেঠ, গঙ্গাবিষ্ণু মেন্দ্রু(?) এবং
অন্যান্য শেঠেদের সরবরাহ করার কথা ছিল(BPC, vol. 23, f.
185vo, l July 1750)।
আরেকটা বিতর্কিত
বিষয় নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে ১৭৫০এর প্রথমের দিকে কোম্পানি যখন দাদনি থেকে
গোমস্তা প্রথায় চলে গ্যাল, সেই ব্যবসায়িক রণনীতির কারণ ব্যখ্যা করতে গিয়ে বহু গবেষকের
বক্তব্য বাংলার ব্যবসা আর ব্যবসায়ীদের সার্বিক পতনের পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল বলেই
ব্রিটিশ কোম্পানি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আমরা আলোচনা করে দেখিয়েছি,
পলাশীপূর্ব বাংলায় ব্যবসা বা ব্যবসায়ীদের কোন দুর্দশা ঘটে নি, পুঁজি বিনিয়োগের
মাধ্যম বদলের কারণ ভিন্ন, তার সঙ্গে ব্যবসার ওঠাপড়ার কোন যোগ নেই। কলকাতার
প্রখ্যাত দুই পরিবার যেমন শেঠ আর বসাক বা মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারের কাটমা পরিবার
পঞ্চাশের দশকেও তাদের ব্যবসায় মাহির ছিলেন। বড় ব্যবসায়ি যেমন জগতশেঠ, উমিচাঁদ বা
খ্বাজা ওয়াজিদ এই সময়ে তাদের ব্যবসায়িক সম্ভাবনার শীর্ষে উঠেছিলেন। যতদিন এই বড়
ব্যবসায়িরা সচল ছিল ততদিন বাংলার ধারের বা পুঁজির বাজার তেজি ছিল এবং পুঁজি পাওয়া
কোন সমস্যা ছিল না এমন কি ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও। আসল ব্যাপার হল দাদনি
ব্যবসায়ীরা তাদের দেওয়া শর্ত ছাড়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে অস্বীকার করে ১৭৫৩
সালে। সেই টালমাটাল সময়ে ব্যবসায়ীরা নিজেদের বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তিত ছিলই। সে সময় কোম্পানির
আমলাদের দেওয়া শর্ত অর্থাৎ দাদনি মোট চুক্তি অঙ্কের ৩০ শতাংশের বেশি অগ্রিম দেবে
না, যদিও আগে এই অগ্রিমের অঙ্কটা ছিল ৮৫ শতাংশ এটা মানতে রাজি হয় না। এছাড়াও আরও
একটা শর্ত চাপানো হয় যে কোন ধরণের পণ্য সরবরাহের ঘাটতির জন্যে ১০% জরিমানা ধার্য
হবে (Ibid.,
vol. 26, f. 164, Annex. to Consult. 7 June t,753)। এই সব শর্ত
ব্যবসায়ীদের কাছে অযৌক্তিক এবং অন্যায্য বলে মনে হয়েছিল। এছাড়াও কোম্পানির
আমলাদ্দের ব্যক্তিগত ব্যবসা পঞ্চাশের দশক থেকে দ্রুতগতিতে কমছিল, এবং কোম্পানির
আমলাদের কাছে দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় চলে যাওয়ার অর্থ নিজেদের ব্যবসাকে আবার
বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ করে নেওয়া।
No comments:
Post a Comment