সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টে হকার আইন গৃহীত হয়েছে। আমরা যারা অন্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত, বা আগে অনেক দিন এই আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে ছিলাম, তাঁদের মনেতো আনন্দ হচ্ছেই। এ অনেক বড় পাওনা। বিশেষ করে ক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গী পালটানো খুব কম কথা ছিল না। তবে এটাও মনে রাখা দরকার ছিল, যারা রাষ্ট্রের কাছে ননএন্টিটি ছিল তাদের একটা বন্ধনে বেঁধে ফেলল ক্ষমতা। তবুও এই আইন ভারতের আন্দোলনের ইতিহাঈ একটি মাইল ফলক। যেহেতু সম্পাদকদের একজন এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন, সেহেতু তার আনন্দ একটু বেশী।
নিচে এই প্রসঙ্গে একটি ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করা গেল। এটি প্রকাশিত হয়েছিল অন্যতম সম্পাদকের সম্পাদনায় প্রকাশিত একটি বইতে। সেই লেখাটি তিন বছর আগের। নতুন করে সম্পাদনা না করে সেটি প্রকাশ করা গেল।
নিচে এই প্রসঙ্গে একটি ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করা গেল। এটি প্রকাশিত হয়েছিল অন্যতম সম্পাদকের সম্পাদনায় প্রকাশিত একটি বইতে। সেই লেখাটি তিন বছর আগের। নতুন করে সম্পাদনা না করে সেটি প্রকাশ করা গেল।
ভারতবর্ষের গ্রাম সমাজের কেন্দ্রবিহীন উত্পাদন এবং
ব্যবসার পরিকাঠামো এবং একই দর্শণএ জারিত গ্রামীণ সমাজের পরিচালন ব্যবস্থা সঙ্গে
শহুরে প্রায়একতান্ত্রিক এককউদ্যমী উত্পাদন ব্যবস্থাকেও সঙ্গে নিয়ে হাজার হাজার বছর
ধরে ভারতীয় সভ্যতা, ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির সমাজ, নানান দর্শণের জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে
নিয়ে বেঁচে এসেছে। কয়েক হাজার বছর ধরে বিশ্ব শিল্প উত্পাদনের প্রায় ৮০
শতাংশ উত্পাদন করত ভারত, পারস্য আর চিন। ভারতের ব্যবসা অথবা উত্পাদন
ব্যবস্থা নিয়ে শহুরে বর্তমান জ্ঞণচর্চার অন্যতম মুখ্য অক্ষদন্ড তত্কালীন শহুরে
নানান পরিকাঠামো এবং বিদেশে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের নানান উদ্যম বিশ্লেষণ। দীর্ঘদিন
ধরে ভারতের বিশ্ব শিল্প উত্পাদনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শুধুই বৈদেশিক বাণিজ্যের
অথবা শুধুই শহুরে গিল্ড ভিত্তিক উত্পাদন পরিকাঠামো যথেষ্ট ছিল। এ ধারণা
বোধ হয় সঠিক নয়। বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদন করা শহুরে উজ্জ্বলতম শ্রেষ্ঠী,
সার্থবাহরা বহুদিনধরেই শহুরে গবেষকদের কল্যাণে প্রচারের আলো পেয়ে এসেছেন নিজগুণেই। এঁদের
সম্মান দিয়েও তথ্যের জন্য বলাদরকার এই ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাঙলা তথা ভারতের
তৃণমূলস্তরের অকেন্দ্রিভূত উত্পাদকের সঙ্গে মিলে তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীরা দেশজুড়ে
নানান সমবায়ী সমাজের উত্পন্ন পণ্যদ্রব্য ভান্ডারের বিশাল এক দেশজ বাজার তৈরি করতে
পেরেছিলেন।
ব্রিটিশ-পুর্ব
ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য, বিশেষ করে ইয়োরোপের সঙ্গে বাণিজ্য, ব্রিটিশ-উত্তর কালের
ভারতে যতটা বেশী আলোচনা হয়েছে, তার কয়েক শতাংশ কিন্তু ভারতের সঙ্গে এশিয়া বা
আফ্রিকার দেশগুলোর বাণিজ্য এবং বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয় নি। অথচ আমরা
দেখেছি বাংলার সঙ্গে সিংহলের দীর্ঘ দিনের বাণিজ্য সম্পর্ক। অনেকেই বোধহয় জানি,
মঙ্গল কাব্যের কথা। এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোয় ভারতের অসামান্য সাংস্কৃতিক প্রভাবের
তথ্য অনেকেই জানি। সেই প্রভাবের রেশ পড়েছে স্থানীয়দের জীবন যাত্রায়। ফলে সে
অঞ্চলেও ভারত বাণিজ্য করেছে। আজও ওডিসার কটকে বালি যাত্রা উতসব পালিত হয়, বালি
দেশে বাণিজ্য যাত্রার স্মৃতিতে। পিপলি বন্দরের মাধ্যমে অন্তর্দেশীয় এবং
বহির্বাণিজ্যও সম্পন্ন হত।
অথচ ইয়োরোপীয়রা বারতে আসার বহু আগে থেকেই এ ধরণের
বাণিজ্য সম্পাদন হত। এ তথ্যও খুব প্রচারিত। তবুও ভারতের সঙ্গে ইয়োরোপের বানিজ্যই
যেন অতি প্রাধান্য পেতে শুরু করল ভারতীয় মনীষায়। আরও বড় কথা, ভারতের মোট উৎপাদনের
মাত্র দশ শতাংশ ছিল বৈদেশিক বাণিজ্য, বাকি ৯ ভাগ আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য। সেই সংখ্যা
নিয়ে কত ব্যপক মাতামাতি। এই যে ১০% বৈদেশিক বাণিজ্য তাঁর মধ্যে এশিয়া এবং আফ্রিকারও
অংশিদারি ছিল। তাহলে ইয়োরোপ-ভারত বাণিজ্যের এই অংশিদারি নিয়ে ইয়োরোপীয়রা ভারতকে
বলত তাঁদের শিল্পাগার। ভাল কথা। নাথা নিচু করে মেনেও নিলাম। কিন্তু এর সঙ্গে এই
তথ্যও দিতে হবে সে সময় ভারতে মোট ধনীর সংখ্যা আর ধনীদের ধনের পরিমাণ, ইয়োরোপের
তুলনায় অনেক বেশী ছিল। মনে করুন হাসি পাবে, গর্বও হবে। প্রথম দিন মুর্শিদাবাদের প্রাচুর্য
দেখে লর্ড(তখনও হননি) ক্লাইভের চোখ বড় বর্ননা।
তো, বৈদেশিক বাণিজ্যের তুলনায় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ৯ গুণ। সে যে কত
বড় অর্থনীতি তা এই হাহাকারের যুগে আর কল্পনা করা যাবে না। পলাশী, ক্লাইভ,
হেস্টিংস, ৭৬এর গণহত্যা, ভারতের বি-শিল্পায়ণ, কোম্পানির ব্যক্তিগত ব্যবসাদারদের
অজস্র লুঠের পরও ১৮০৮ সালে পাটনা জেলায় শুধু চরকা কাটুনির সংখ্যা ছিল প্রায় চার
লক্ষ। আন্দাজ করা যেতে পারে ব্রিটিশ-পুর্ব সময়ে আরও কত চরখা চজিল।
শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের চোখ
ধাঁধানো জোরেই নয়, সবল দেশিয় বাজারের ওপর ভিত্তি করেই ভারত একদা শিল্পউত্পাদনে
বিশ্ববাজারের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ভারতবর্ষ জুড়ে, প্রায় কেন্দ্রিয়
নেতৃত্ববিহীন এই উত্পাদন ব্যবস্থার অঙ্গ ছিলেন সারাভারত জুড়ে শহরে পথপার্শ্বে বসে
ব্যবসা করা, গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ানো, নিজেদেরমতকরে হাটে, বাজারে, মেলায়
ছড়িয়েথাকা অসংখ্য সচল এবং স্থায়ী বিক্রেতা। এঁরা আদতে কেন্দ্রবিহীন সামাজিক
উত্পাদন ব্যবস্থাকে সহজে বাজারে নিয়ে যাওয়ার একটি সচল প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করতেন। বরেণ্য ঐতিহাসিক,
গবেষকেরা ভারতের শহরজুড়ে বড় উত্পাদক আর ব্যবসায়ীদের গিল্ড ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তৃত
আলোচনা করেছেন। লেখকদের ধারণায় শহরজোড়া গিল্ডের মোট উত্পাদনের তুলনায়
গ্রামীণ সমাজভিত্তিক শিল্প উত্পাদকেদের উত্পাদন পরিমান ছিল অনেক অনেক বেশি, অনেক
বৈচিত্র্যপূর্ণ।
No comments:
Post a Comment