জয়া মিত্র
দ্য সানডে ইন্ডিয়ানে প্রকাশ পেয়েছিল
রাজনৈতিক আন্দোলন চিরকালই কোনও না কোনও সামাজিক অন্যায়ের নিরসনকল্পেই শুরু হত৷ কিন্তু,সারা বিশ্বেই আজ ধীরে ধীরে সেই আন্দোলনের অভিমুখ পালটাতে শুরু করেছে৷ ভারতেও বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক দলীয় কর্মসূচির আন্দোলনের চেয়ে ক্রমশই বেশি জোরালো হয়ে দেখা দিচেছ স্থানিক কারণে, বিশেষত কোনও এলাকার বাসিন্দাদের আন্দোলন৷ এর অধিকাংশই নিজেদের অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, যাকে ‘পরিবেশ’ বলি, তা রক্ষার আন্দোলনে নামছেন৷
নর্মদা নদীকে বড় বাঁধের থেকে রক্ষার আন্দোলন বা হিমাচল প্রদেশে জঙ্গল রক্ষার জন্য গ্রামের মানুষদের ‘চিপকো’ আন্দোলন হয়তো নদীতে বন্যার প্রথম জলকল্লোল৷ কিন্তু, গত 12-15 বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর এই অধিকার আন্দোলনই ভারতে জনআন্দোলনের প্রধান চেহারা হয়ে যাচেছ৷‘পরিবেশ রক্ষা’ যে এই মানুষদের প্রাণিত করছে, এমন নয়৷ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করেই সেইসব অঞ্চলের হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণ মানুষ জীবনধারণ করেন৷ তার বাইরের কোনও ‘উন্নয়ন’ যখন সেই অত্যন্ত সুস্থায়ী জীবনযাপনের ধরণ থেকে তাদের উৎপাটিত করে তাদের মাটি-ভূগর্ভ-অরণ্য-ঝর্ণা-নদী দখল কর়ার চেষ্টা করে, তখন নিজেদের জীবনে স্থিত থাকার মরিয়া চেষ্টাতেই এই মানুষেরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন৷ ছত্তিশগড়, ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশ,মেঘালয়ের কলপাকরাম -সহ বহু জায়গার স্থানীয় মানুষের খনি-বিরোধী আন্দোলন, শতদ্রু নদীর পং বাঁধ,অরুণাচলের তাওয়াং-এ নিয়ামজাং চু, আসামের ধেমাজিতে গেরুকামুখ, উত্তরপূর্বের তিপাইমুখ, সঙ্গার পার্বত্যধারায় অলকানন্দা-মন্দাকিনীর ধারে, প্রত্যেকটি ছোটবড় বাঁধের আশেপাশে স্থানীয় মনুষদের আন্দোলন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, বর্ধমানের অণ্ডাল-সরষেতলি, মহারাষ্ট্রের নিয়মগিরি, মহাগুজরাত,উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানার অসংখ্য জায়গায় কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরোধী আন্দোলনের বিস্তৃতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে৷
বীরভূমের পাঁচামি-মহম্মদবাজারের 2010 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া বেআইনি পাথরখাদান ও ত্রুাশার-বিরোধী আন্দোলন, চলতি কথায় যা আদিবাসী গাঁওতার আন্দোলন, সেই আন্দোলনের তালিকায় তা এক গৌরবময় সংযোজন৷
অনেক বিশেষত্ব এই আন্দোলনটিকে চিহিুত করছে৷ অন্তত ত্রিশ বছর ধরে সংগঠিত বেনিয়ম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজেদের জমি-জঙ্গল-নদী-পুকুর, মায় বসতগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হওয়া সাঁওতালরা শেষ অবধি যখন প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করলেন়, তখন থেকেই তাঁরা নির্ভর করলেন নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতি ও প্রথায়়৷ 2010-র 8 ফেব্রুয়ারির সকালে আত্রুান্ত গ্রামের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অন্যান্যদের খবর দেওয়ার উপায় হিসাবে তারা বেছে নিয়েছিলেন মাদল৷ ‘আমরা বিপন্ন, তাড়াতাড়ি এসো’ - এই বোল সিধু-কানুর পর আর মাদলে ওঠেনি৷ রাজনৈতিক দলেরা লিফলেট, হ্যান্ডবিল দিয়ে নিজেদের কর্মসূচিতে সামিল করে৷ কিন্তু, খাদানঘেঁষা গ্রামের আদিবাসীরা যখন ডাক দিলেন নিজেদের মানুষদের, নিজেদের প্রাচীন প্রথার কাছেই ফিরে গেলেন৷ রাস্তা খঁুড়ে পুলিশের পথ আটকানোর পাশাপাশি দিনের পর দিন হাটে-মাঠে জমায়েতে আমগাছের প্রশাখা নিয়ে ছুটে গেল গাঁওতা সদস্যরা৷ আর দেখা গেল, ‘মনে আছে! সব মনে আছে!’ সম্মেলক কোনও স্মৃতি যেন জেগে উঠল নিঝুম বিস্মৃতির অতল থেকে৷ নাগরিক জীবনের গ্রামরক্ষী বাহিনী নয়, গ্রামের প্রবেশ পথে তৈরি হল সুসজ্জিত মাচা, গভীর রাত পর্যন্ত পাহারায় জাগলো গানের সুর,মাদল আর নাচের দল৷ বর্ধিষ্ণু গ্রামে আগুন লাগিয়ে, ধানের গোলা পুড়িয়ে সরাসরি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উগ্র উসকানি সত্ত্বেও আন্দোলন রইল অহিংস৷ তির-ধনুক-বর্শা-টাঙ্গি আদিবাসীর পোশাকেরই যেন অংশ৷ মিছিলে-সমাবেশে সেসব রইল আগের চেয়ে বেশি, কিন্তু একটি অস্ত্রও ব্যবহূত হল না৷ ‘মার কা বদলা মার’ বা ‘ইট কা বদলা লোহে সে’ জাতীয় চটকদার কোনও স্লোগানই দিল না আন্দোলনকারীরা৷ তারা তালবাঁধ গ্রাম গ্রাস করতে উদ্যত কামাল খানের খাদানে ‘চরকা’ দিয়ে এল৷ 34 নম্বর জাতীয় সড়কে এক ত্রুাশারে একটি আদিবাসী ছেলেকে হেনস্থার ঘটনায় ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে সেই মালিকের সমস্ত খাদান-ত্রুাশারে চরকা দেওয়ার হুঁশিায়ারি দিল৷ কয়েকটি খড় ও সুতোয় গিঁট দেওয়া সেই ‘চরকা’অগ্রাহ্য করার সাধ্য কিন্তু এখনও কারও হয়নি৷
গাঁওতা যে কারণে আন্দোলনে নামল, তা কিন্তু সরকারি উদ্যোগের বিষয় হওয়ার কথা৷ আন্দোলনই বলে দিল, বীরভূমের পাথরখাদানগুলি যে জমিতে তৈরি, যেভাবে চলে, যে বিস্ফোরক ব্যবহূত হয় - তার কোনটই বৈধ নয়৷ গাঁওতার আন্দোলনের মূল দাবি, কেবল সেই সব খাদান ও ক্রাশার চলুক যেগুলি আইনত বৈধ৷ অনিয়ন্ত্রিত পাথর তোলা ও পাথর ভাঙার ফলে এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যই যে শুধু বিপন্ন হচেছ, তা নয়৷ মাঠ-ফসল-ক্ষেত, জলের উৎস ছোট ছোট নদী, পুরনো পুকুর, ঝোপজঙ্গল – যা এই সমাজের কৃষিজীবী আদিবাসী সমাজের জীবনযাপনের অপরিহার্য অঙ্গ– সেই সবকিছু ধবংস হচেছ৷ ফলে বিপন্ন হয়েছে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন৷
গত দু-বছরে এই দাবির সত্যতা আরও বেশি প্রমাণ হয়েছে৷ খাদান ও ক্রাশার বন্ধ থাকার ফলে বিস্ফোরণ, পাথরভাঙা ধুলো, চোলাই মদ ও আনুষঙ্গিক নানা দোকান, অসংখ্য বাইরের লোক বয়ে আনা ট্রাকের আনাগোনা বন্ধ আছে৷ ফলে গ্রামে ফিরছে সাঁওতাল জীবনের স্বাভাবিক শ্রী৷ নিজেদের জীবনকেই পুনর্বাসিত করছেন গ্রামবাসীরা৷ দু-বছরের কম বৃষ্টির সমস্যা সামাল দিয়ে রাসায়নিক দিয়ে চাষের বদলে নিজেদের প্রচীন নিয়মের চাষে ফিরছেন তাঁরা৷ ভুট্টা, ডাল, স্থানীয় সবজি চাষ, মাছ, শুয়োর ও মুরগি পালন–তাও আবার বাজারে বেচার জন্য নয়, শুরু হয়েছে৷ তার জন্য কোনও প্রকল্প, কোনও দফ৲তর দরকার হয়নি৷ গ্রামসমাজ করেছে নিজস্ব নিয়মে৷ নিজেদের সংগঠন ‘মাঝি পারগানা বাইসি’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে,কোনও মাঝিহাড়াম (গ্রাম প্রধান) কোনও দলে যোগ দিতে পারবে না৷ গাঁওতা গ্রামে গ্রামে গাছ লাগাচেছ,নিজে হাতে পুকুর কাটছে৷ সাংসারিক অশান্তির জায়গা নিয়েছে মেলা-উৎসব-পরব৷ গাছে গাছে ফিরেছে পাখি, শুখনো কুয়োয় আবার জল দেখা যাচেছ৷
খাটিয়ে মানুষদের এটাই ধরণ৷ তাদের সুন্দর জীবন সুশৃঙ্খল জীবন প্রকৃতি-নির্ভর৷ তাদের জীবনচর্যা স্বাভাবিক নিয়মেই পরিবেশরক্ষার ব্যবস্থা করে - প্রাকৃতিক ও সামাজিক উভয়ক্ষেত্রেই৷ ওডিশার নুয়াগড়ে ন্যাড়া হয়ে যাওয়া পাহাড়ে গাছ লাগানোর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের গ্রামে৷ নর্মদা ঘাঁটির মানুষ গড়ে তোলেন সুকল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মায় বিকল্প বিদু্যৎকেন্দ্র পর্যন্ত৷ রাজস্থানে আদিগন্ত মরুভূমির মাঝে বিন্দু বিন্দু জল সঞ্চয় করে গ্রামবাসীরা গড়েন জলাশয়, শস্যক্ষেত্র৷ সন্ত্রাস, অর্থের লোভ ও চাপ, চূড়ান্ত বিরোধিতাকে জয় করেই আদিবাসীরা গড়ছেন নিজেদের এক সুন্দর গ্রামসমাজ৷
No comments:
Post a Comment